গাড়ির চাবিটা হারিয়ে ফেলেছেন। এই মাত্র বইটি রাখলেন কিন্তু খুঁজে পাচ্ছেন না। পরিচিত মানুষটার নাম মনে করতে পারছেন না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ভাবছেন আপনার স্মৃতিশক্তি লোপ পাচ্ছে। ভয় পাচ্ছেন মনে মনে। আসলে এটা তেমন কোনো সমস্যাই না।
তবে হ্যাঁ একেবারেই মনে করতে পারছেন না বা বেমালুম ভুলে গেছেন আপনি গাড়িটি কোথায় পার্ক করেছেন! তবে ভাবনার কথা বই কি। আমরা স্বাভাবিকভাবেই প্রতিদিন কিছু স্মৃতি হারাই। স্মৃতি না হারালে একদিন স্মৃতির পাহাড়ের আড়ালে আমরা আমাদেরকেই হারিয়ে ফেলবো। তাই এটা ভাবনার বা ভয়ের কোনো ঘটনা নয়। তবে আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে এই স্মৃতি হারাবার মাত্রাটা যাতে সিরিয়াস পর্যায়ে না যায়। স্মৃতি শক্তি হারানোর রহস্য নিয়ে লিখেছেন নাজমুন নাহার মিলি
স্মৃতিশক্তি কী?
স্মৃতি হচ্ছে মনে রাখা। কোনো ঘটনা বা বিষয় স্বল্প বা দীর্ঘসময়ব্যাপী মনে রাখা। এই স্মৃতি ধারণ করার ক্ষমতাই হলো স্মৃতিশক্তি। গবেষণায় জানা যায়, স্মৃতিশক্তি তৈরি হয় এক জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, যাতে জড়িত থাকে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ ও বিভিন্ন যোগাযোগ-প্রক্রিয়া।
স্মৃতিশক্তি সাধারণত দুই ধরনের- স্বল্পস্থায়ী স্মৃতিশক্তি ও দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিশক্তি।
স্বল্পস্থায়ী স্মৃতিশক্তি : যখন মস্তিষ্ক স্বল্প সময়ের জন্য তথ্য ধরে রাখে অর্থাৎ কয়েক সেকেন্ড বা কয়েক মিনিটের জন্য, তাকে স্বল্পস্থায়ী স্মৃতিশক্তি বলে।
দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিশক্তি : মস্তিষ্ক যখন উদ্যমের মাধ্যমে ক্রিয়া করে, হতে পারে সেটি সজ্ঞানে অথবা অজ্ঞানে এবং যা নিজের কাছে খুবই অর্থবহ, সেগুলোই দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিশক্তির রূপ নেয়। দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতির ক্ষেত্রে মানুষ দীর্ঘসময় ধরে কোনো বিষয় মনে রাখতে পারে।
যে কারণে লোপ পায় স্মৃতিশক্তি
২০ বছর বয়সটি আমাদের স্মৃতির জন্য একটি বিশেষ সময়। এই সময় আমরা একটি ধাপ অতিক্রম করি। স্বাভাবিকভাবে গঠনগত কারণেই খুব ধীরে ধীরে আমাদের স্মৃতিশক্তি কমতে থাকে এ সময় থেকেই। পঞ্চাশের পর আমরা কোথায় কোন জিনিস রাখি তা ভুলে যাই। এক জায়গায় রেখে খুঁজি আরেক জায়গায়। এপয়েন্টমেন্ট ভুলে যাই। নতুন কারো সাথে পরিচয় হলে নাম মনে রাখাটা হয়ে যায় দু:সাধ্য। কিন্তু কেন এমন হয়?
নানা কারণে এমনটি হয়ে থাকে। স্বাস্থ্যগত ও আরো অন্যান্য কারণ এর জন্য দায়ী। স্ট্রোক, ব্রেইন টিউমার, হরমনজনিত সমস্যা যেমন থাইরয়েড গ্রন্থির অতিক্ষরণ বা কমক্ষরণ ইত্যাদি নানা কারণে স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে পারে। তা ছাড়া এইচআইভি, যক্ষ্মা, সিফিলিস (শেষ পর্যায়ে), চর্মরোগ, ব্যাকটেরিয়াজনিত মস্তিষ্কের প্রদাহ (ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিস) ইত্যাদিও স্মৃতি হারানোর জন্য বিশেষভাবে দায়ী। ভিটামিন বি ১, বি ১২-এর ঘাটতিও আপনার স্মৃতিশক্তি কমিয়ে দিতে পারে।
আমরা অনেক সময় অনেক ওষুধ সেবন করি যা আমাদের স্মৃতিশক্তির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। যেমন- ব্যথা নাশক ওষুধ, ঘুমের ওষুধ, বিষন্নতা নিবারণী ওষুধ ইত্যাদি খেলে অনেক ক্ষেত্রে আমরা স্মৃতি হারাই। মাথায় আঘাতজনিত কারণেও স্মৃতি হারাতে পারে। যারা অ্যালকোহল সেবন করেন তাদের স্মৃতি হারাবার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি। মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, অনিয়মিত ঘুম বা নিদ্রাহীনতা, বিষন্নতা ইত্যাদিও আমাদের স্মৃতিশক্তি লোপ পাবার অন্যতম কারণ।
কর্টিসল (একটি স্ট্রেস হরমোন) মস্তিষ্কের হিপপোক্যাম্পাসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যদি স্ট্রেস (মানসিক চাপ) দীর্ঘস্থায়ী হয়। স্ট্রেস মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটায়। ঘুমের সমস্যা যেমন- ‘ইনসোমনিয়া’ আপনাকে ক্লান্ত রাখবে এবং দিনের বেলায় আপনার মনোসংযোগে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে। ধূমপান বা অ্যালকোহল পানে মস্তিষ্কে স্ট্রোক হয়ে স্মৃতিহারা হতে পারেন। তা ছাড়া এই ধূমপান করার ফলে ধমনি সরু হয়ে মস্তিষ্কের অক্সিজেন-প্রবাহ কমিয়ে দেয় যা আপনার স্মৃতিশক্তি দুর্বল করে দিতে পারে।
স্মৃতিশক্তি বাড়াবার এবং নষ্ট না হবার কিছু কৌশল
কোলেস্টোরেল নিয়ন্ত্রণ
মস্তিষ্কে কম রক্ত প্রবাহ হলে তা স্মৃতিশক্তির ওপর খারাপ প্রভাব ফেলে। ৩ হাজার ৭শ’ লোকের মধ্যে এক ব্রিটিশ গবেষণায় দেখা যায়, কম রক্ত প্রবাহের কারণে এবং এইচডিএলের নিম্ন স্তরের কারণে স্মৃতিশক্তি হারানোর ঝুকি ৫০% বেড়ে যায়। এ দিকটি মাথায় রেখে এইচডিএল বাড়াতে হবে। কোলেস্টোরেল নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
মস্তিষ্কের ব্যায়াম
আমরা শারীরিক গঠন ও শক্তি ঠিক রাখার জন্য প্রতিদিন ব্যায়াম করি। কিন্তু মস্তিষ্কের ব্যায়াম? প্রথমে তো শুনে আপনার হো হো হাসিই পেতে পারে। কিন্তু জেনে রাখুন, মাংসপেশির শক্তির মতো স্মৃতিশক্তিও ‘ব্যবহার করুন অথবা হারান’-এ নীতিতে চলে। আপনি যত মস্তিষ্কের ব্যবহার করবেন, আপনার স্মৃতিশক্তিও তত ধারালো হবে। আর মস্তিষ্ককে অধিক সক্রিয় করতে ‘নিউরোবিক’ ব্যায়াম করুন প্রতিদিন। যেমন- চোখ বন্ধ করে গোসল করা বা ড্রেসআপ করা, নতুন খেলা শেখা, খবরের কাগজে নতুন নতুন পাজল বা ক্রসওয়ার্ড চর্চা করা করুন। সম্ভব হলে প্রতিদিনই। যাঁরা নিয়মিত বুদ্ধির চর্চা করেন বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের স্মৃতি হ্রাস তুলনামূলকভাবে কম হয়। তাই ভালো স্মৃতিশক্তি পেতে চাইলে নিয়মিত পড়ুন, শিখুন ও সমস্যা সমাধানে অংশগ্রহণ করুন। অলসভাবে বসে থাকলে স্মৃতিশক্তি ভোঁতা হয়ে যায়।
মনোযোগ দিয়ে পড়ুন
আপনার স্মৃতিতে ধরে রাখতে হলে বিষয়টি মস্তিষ্কে লেখা হতে হবে। আর যদি যথেষ্ট মনোযোগ না দেন, মস্তিষ্কে লেখার কাজটি হবে না। মস্তিষ্কের যথাযথ স্থানে একটি তথ্যের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে প্রায় আট সেকেন্ড সময় লাগে। তাই বহু কর্ম একসঙ্গে করতে গেলে মনোযোগ নষ্ট হয়। তাই মনোযোগের সাথে ধীরে কাজ করুন।
অন্বেষা পরীক্ষার আগে পড়ার সুযোগ পায়নি। কিন্তু পরীক্ষা তো দিতেই হবে। হলে যাবার আগে সে তার এক সহপাঠীকে বলল- এই প্রশ্নের উত্তরগুলো আমাকে একবার বলবে? সহপাঠী তাকে উত্তরগুলো পড়ে শুনালো। দেখা গেলো ওই একবার শুনে সে পরীক্ষায় ভালো করলো। অর্থাৎ অন্বেষার শুনে শেখার ক্ষমতা ভালো। তবে অধিকাংশ মানুষ দেখে শেখে। তারা ভালোভাবে শেখে পড়ে পড়ে অথবা যা দেখার তা দেখে দেখে।
লিখে রাখুন
যা মনে রাখতে চান সে বিষয়গুলো খাতায় বা ডায়েরিতে লিখুন। জটিল বিষয়গুলোর নোট নিন এবং পরে ক্যাটাগরি অনুযায়ী পুনর্বিন্যাস করুন। অপেক্ষাকৃত বেশি জটিল বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নভাবে মুখস্থ করার চেষ্টা না করে মৌলিক ধারণার ওপর জোর দিন। বিষয়টি আগে নিজে বুঝে নিন, তারপর অন্যকে নিজের ভাষায় বোঝানোর ক্ষমতা অর্জন করুন। দেখবেন অনেক সহজ হয়ে গেছে।
স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভাস
স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন। ভালোলাগার জন্য নয়, পুূিষ্টকর খাবার খান। নিয়মিত শরীরচর্চা করুন। খাদ্যতালিকায় এমন খাবার রাখুন যার খাদ্যমান অনেক বেশি। ফল, শাকসবজি, খোসাসমৃদ্ধ দানাদার শস্য ও স্নেহজাতীয় (শস্যদানার তেল, মাছের তেল) খাদ্যে অনেক স্বাস্থ্য উপকারী গুণ আছে। পাশাপাশি এগুলো স্মৃতিশক্তির উন্নয়ন ঘটায়। নিচে কিছু স্মৃতিশক্তি-সহায়ক খাদ্য-উপাদান দেয়া হলো-
ভিটামিন বি-৬, বি-১২ এবং ফলিক এসিড আছে- পালংশাক ও গাঢ় সবুজ শাক, অ্যাসপারাগাস, স্ট্রবেরি, বাঙ্গি, তরমুজ, শিমের কালো বিচি এবং অন্যান্য ডালজাতীয় শস্যদানা, টকজাতীয় ফল ও সয়াবিনে।
অ্যান্টি অক্সিড্যান্টসমূহ আছে জাম, মিষ্টি আলু, লাল টমেটো, পালংশাক, ব্রকলি, সবুজ চা, বাদাম ও বিচি, টকজাতীয় ফল এবং কলিজায়।
তাই বিভিন্ন ধরনের রঙিন শাকসবজি ও ফল খান। সাথে উদ্ভিদজাত তেল দিয়ে রান্না করা তরকারি খান। প্রাণীজ তেল আপনার ধমনি সরু ও বন্ধ করে দিতে পারে। এগুলো পরিহার করলে তবেই মস্তিষ্ক আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তখন আপনি হয়ে উঠতে পারেন একজন স্মৃতিধর মানুষ।
স্বাস্থ্যবান্ধব অভ্যাসগুলো লালন
– আপনাকে চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দুশ্চিন্তা বা টেনশনে মানুষের অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি থেকে গ্লুকোকরটিকয়েড নামক এক ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোন মস্তিষ্কের কোষগুলোকে দ্রুত আক্রান্ত করে। মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করুন।
– অ্যালকোহল ও ধূমপান থেকে বিরত থাকুন।
– স্বভাবের দিক দিয়ে গোছানো হলে অনেক কিছুই সহজে মনে থাকে। নির্দিষ্ট জিনিস সব সময় নির্দিষ্ট জায়গায় রাখলে প্রয়োজনের সময় হাতড়ে বেড়াতে হয় না।
– নেতিবাচক চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলুন। সন্দেহবাতিক মন মস্তিষ্কের ক্ষতি করে।
– মনের সঙ্গে মস্তিষ্কের যোগাযোগটা খুব গভীর। তাই মনের পরিচর্যা করুন। নিজেকে নিয়োজিত রাখুন সৃষ্টিশীল কাজে।
– নিয়ম করে দিনের কিছু সময় মেডিটেশন করুন। যোগ ব্যায়াম করতে পারেন। সম্ভব না হলে অন্তত সকাল-সন্ধ্যা খোলা ময়দানে হাঁটুন। নামাজের ভেতর এ সবগুলো উপাদানই বিদ্যমান। তাই মুসলমানরা নিয়মিত নামাজ আদায়ের চেষ্টা করুন।
– সারাক্ষণ কাজ আমাদের মস্তিষ্ককে ক্লান্ত করে তোলে। ক্লান্তি মস্তিষ্কের কাজ করার ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়। তাই পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন।
স্মৃতিশক্তি দৃঢ় করতে ঘুম
স্মৃতিশক্তি সংহত বা দৃঢ় করার জন্য ঘুম চাই। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে পড়া বা শেখা বিষয়গুলোকে মনে রাখার জন্য ঘুম দরকার। বোস্টনের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের ঘুম গবেষক জেফরি এম ইলেনবোগেন বলেন পড়া পড়ে মগজে ঢোকানো, পঠিত বিষয়গুলো মগজে স্থিত করা এবং পরে ব্যাপারগুলো মনে করতে পারা। কোনো কিছু শেখার ব্যাপারকে এই তিনটি স্তরে ভাগ করা যেতে পারে।
এর মধ্যে পড়ে মগজে ঢোকানো এবং পরে বিষয়গুলো মনে করতে পারা এ দুটো স্তর সম্পন্ন হয় জেগে থাকা অবস্থায়। আর শেখা, পঠিত বা মুখস্থ বিষয় মগজে স্থিত হওয়ার ব্যাপারটি ঘটে ঘুমের সময়। সুতরাং নিয়ম মাফিক ঘুমের অভ্যাস গড়ে তুলুন।
হাইফা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রেইন অ্যান্ড বিহেভিয়ার রিসার্চ সেন্টারের গবেষণায় দেখেছেন, দিনের বেলায় ৯০ মিনিটের হালকা ঘুমও স্মৃতিশক্তিকে দীর্ঘস্থায়ী করতে সহায়ক। এমনকি ছয় মিনিটের ঘুমও স্মৃতিশক্তিকে সংহত করতে পারে এ রকম ফলই পেয়েছেন জার্মানির ডুসেলডর্ফ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণায়।
যুক্তরাষ্ট্রের স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য প্রসেডিং অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের বিশেষজ্ঞরা জানান ভাঙা ভাঙা ঘুম স্মৃতিশক্তি নষ্ট করে ফেলতে পারে। মস্তিষ্ক ও ঘুম দুটি পারস্পরিক বিষয়। প্রায়ই দেখা যায়, ঘুম পুরো হওয়ার আগেই কেউ যদি জেগে যায় তাহলে সে হঠাৎ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এ রকম বারবার হলে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
পর্যাপ্ত ঘুম না হলে আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের নিউরনগুলো ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। শেখা জিনিস মস্তিষ্কে সংহত হয় না। অতএব, মনে করার শক্তি বাড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত ঘুম চাই।
very useful information