ব্রাহ্মস্কুল থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

মো: হুমায়ূন আহমেদ
প্রতিনিধি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেষে ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাত্র ছয় বছর পূর্ণ হলেও প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে প্রায় দেড়শ’ বছরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ব্রাহ্মস্কুল থেকে জগন্নাথ স্কুল, এরপর ইতিহাসের পালাক্রমে সেটি আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ পেতে জগন্নাথকে পেরুতে হয়েছে বহু চড়াই উৎড়াই। প্রাচীন এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির জীবনে একাধিকবার পালাবদল হয়েছে। এর জন্মলগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত ব্রাহ্মস্কুল-জগন্নাথ স্কুল-জগন্নাথ কলেজ-জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ-সরকারি জগন্নাথ কলেজ, সরকারি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এবং বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষাঙ্গন পরিচিতি বিভাগে এ সংখ্যার আয়োজন এই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে।

ইতিহাস
ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকায় যখন ব্রাহ্মআন্দোলন বিকশিত হতে থাকে তখন আন্দোলনের নেতারা একটি স্কুলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তখন ব্রজসুন্দর মিত্র, অনাথ বন্ধু মৌলিক, পার্বতীচরণ রায় ও দীনানাথ সেনের যৌথ প্রচেষ্টায় ১৮৫৮ সালে ব্রাহ্মস্কুল স্থাপিত হয়। ১৮৬৮ সালে স্কুলটি টিকিয়ে রাখার জন্য বালিয়াটির জমিদার কিশোরী লাল রায় চৌধুরীর হাতে দেয়া হয়। তিনি স্কুলটির নাম বদলে তার পিতার নাম অনুসারে ‘জগন্নাথ স্কুল’ রাখেন।
বৃটিশ ভারতে শিক্ষার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ১৮৮৪ সালে জগন্নাথ স্কুলকে ‘ঢাকা জগন্নাথ কলেজ’-এ উন্নীত করা হয়। পরবর্তীতে ১৮৮৭ সালে স্কুল ও কলেজ শিক্ষা বিভাগের নির্দেশে পৃথক হয়ে যায়। তখন স্কুলের নাম হয় ‘কিশোরী লাল জুবিলী স্কুল’ (বর্তমানে কে এল জুবিলী স্কুল)।
১৯২০ সালে ভারতীয় লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ‘জগন্নাথ কলেজ অ্যাক্ট’ আইন পাস করে নথিভুক্ত করে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে কলেজটিতে স্নাতক পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ হয়ে যায় এবং এটি ‘জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ’ নামে প্রতিষ্ঠা পায়। এর ২৮ বছর পর ১৯৪৯ সালে পুনরায় স্নাতক পাঠ্যক্রম শুরু হয়।
১৯৬৮ সালে জগন্নাথ কলেজকে সরকারি কলেজে রূপান্তরিত করা হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে এখানে সম্মান ও স্নাতকোত্তর চালু হয়। পরে এটিকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রূপান্তর করা হয়। ১৯৮২ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে ভর্তি বন্ধ করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯১-৯২ শিক্ষাবর্ষ থেকে সরকারি জগন্নাথ কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত ২০০৫ সালের ২৮ নম্বর আইনের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ সরকারি কলেজটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয় এবং ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চারটি অনুষদে ২৮ বিভাগে প্রায় ২৩ হাজার ছাত্রছাত্রী এবং প্রায় ৩৭৪ জন শিক্ষক রয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড: এ কে এম সিরাজুল ইসলাম খান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড: মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদসমূহ
১. কলা অনুষদ
২. সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ
৩. বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ
৪. বিজ্ঞান অনুষদ
কলা অনুষদ
– বাংলা
– ইংরেজি
– দর্শন
– ইতিহাস
– ইসলামিক স্টাডিজ
– ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি
– আইন
– নৃবিজ্ঞান
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ
– অর্থনীতি বিভাগ
– রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
– সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ
– গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
– সমাজকর্ম বিভাগ
বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ
– ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ
– হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ
– মার্কেটিং বিভাগ
– ফিন্যান্স বিভাগ
বিজ্ঞান অনুষদ
– পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ
– গণিত বিভাগ
– রসায়ন বিভাগ
– পরিসংখ্যান বিভাগ
– উদ্ভিদ বিজ্ঞান
– প্রাণিবিদ্যা
– মনোবিজ্ঞান
– ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ
– ফার্মাসি বিভাগ
– কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ

ভর্তি পদ্ধতি
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রার্থীকে এইচএসসি/সমমানের ডিগ্রিধারী হতে হবে। বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখার জন্য এসএসসি ও এইসএসসি মিলে ৭.৫ এবং মানবিক ও অন্যান্য শাখার জন্য গ্রেড পয়েন্ট ৭ থাকতে হয়।  মোট ৪ টি ইউনিটে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করা হয়।
এসএমএস-এর মাধ্যমে ভর্তির আবেদন করা যায়। প্রাথমিক আবেদনপত্রের দাম ৩৫০ টাকা। প্রতিবছর ২৭৫৫টি আসনে ভর্তি নেয়া হয়। ভর্তির ক্ষেত্রে ওয়ার্ড কোটা, উপজতি কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা এবং প্রতিবন্ধি কোটা আছে।

ডিগ্রিসমূহ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স, মাস্টার্স, এমবিএ ডিগ্রি দেয়া হয়। এ ছাড়াও আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রির কার্যক্রম শুরু হবে।

আবাসিক হল
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৫ -এর সংশ্লিষ্ট ধারা মোতাবেক বিলুপ্ত জগন্নাথ কলেজের অধীনে ১২টি হল ছিল। কিন্তু ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্থানীয় জনসাধারণের সাথে আবাসিক হলগুলিতে অবস্থানরত ছাত্রদের সংঘর্ষের পর তা বেদখল হয়ে যায়। বর্তমানে ২টি হল (বাণী ভবন, হাবিবুর রহমান হল) ও  একটি খেলার মাঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের দখলে এসেছে। বেদখল হয়ে যওয়া বাকি হলগুলো হচ্ছে- শহীদ আজমল হোসেন হল, শহীদ আনোয়ার শফিক হল, শহীদ সাহাবুদ্দিন হল, তিব্বত হল, আব্দুর রহমান হল, সহিদুর রহমান হল, বজলুর রহমান হল, নজরুল ইসলাম হল ও আব্দুর রউফ হল।

ভাস্কর্য : মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও ৭১ এর গণহত্যা
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি  ও ৭১-এর গণহত্যা শীর্ষক ভাস্কর্যের অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে  নির্মিত এ ভাস্কর্য দেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্য। অপরূপ সৌন্দর্যের এ ভাস্কর্যটি দৃঢ়চিত্তে প্রকাশ করছে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি আর পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যা। ২০০৮ সালের ৩১ মার্চ ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ড. সিরাজুল ইসলাম খান। ভাস্কর্যটির প্রধান নির্মাণশিল্পী রাসা। এছাড়াও সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন রাজীব সিদ্দিকী, রুমী সিদ্দিকী, ইব্রাহিম খলিলুর রহমান ও মিয়া মালিক রেদোয়ান।

কৃতি শিক্ষার্থী
এই প্রতিষ্ঠানে অনেক জ্ঞানী ও গুণীজন পড়াশোনা করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন- ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু, সংসদ সদস্য ডা: মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, সংসদ সদস্য মো: মিজানুর রহমান খান দিপু, সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, সংসদ সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাংবাদিক জগলুল আহমদ চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী কাজী ফিরোজ রশিদ, অ্যাডভোকেট কে এম সাইফুদ্দীন আহমেদ, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড: সালাহউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক মোতাহার হোসেন সুফী, সাংবাদিক দেওয়ান মুহাম্মদ ইউনুছ, হায়াৎ মাহমুদ, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, আল-মুজাহিদী, অধ্যাপক আ ফ ম খোদাদাদ খান, প্রখ্যাত চিত্রাভিনেতা প্রবীর মিত্র, এ টি এম শামসুজ্জামান, কথা সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, কণ্ঠশিল্পী ফকির আলমগীর, কিরণ চন্দ্র রায়, সৈয়দ হায়দার হোসেন, সৈয়দ আব্দুল হাদী, অভিনেতা জাহিদ হাসান, দলিল উদ্দিন ম ল, ড. আনিসুজ্জামান, ব্রজেন দাস, প্রেমেন্দ্র মিত্র, জয়নুল আবেদিন, তাজউদ্দীনআহমেদ (বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী), বিপ্লব (শিল্পী),ফারুক (অভিনেতা) প্রমুখ।

এক নজরে

মটো : শিক্ষা, ঈমান, শৃঙ্খলা
প্রতিষ্ঠা : ২০০৫ সাল
চ্যান্সেলর : রাষ্ট্রপতি
ভাইস চ্যান্সেলর : অধ্যাপক ড. মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ
প্রথম ভিসি : ড. একেএম সিরাজুল ইসলাম খান
অবস্থান : ১০, চিত্তরঞ্জন এভিনিউ, ঢাকা
শিক্ষার্থী : প্রায় ২৩ হাজার
শিক্ষক : প্রায় ৪শ
বিভাগ : ২৮টি
ওয়েবসাইট : www.jnu.ac.bd

ক্যারিয়ার, ট্রেনিং ও স্কলারশিপ সম্পর্কে
exclusive তথ্য পেতে ফেসবুক গ্রুপে
জয়েন করুন-

Career Intelligence | My Career Partner

Scroll to Top