মো: বাকীবিল্লাহ : ঐতিহাসিকভাবে ‘শিক্ষার্থী‘ শব্দটি দ্বারা এমন কাউকে বোঝায় যিনি কিছু শেখেন। তবে ছাত্র শব্দের সাম্প্রতিক সংজ্ঞা হচ্ছে- যিনি স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। আজকের শিক্ষার্থী আগামী দিনের নেতা। তাদের গুণাবলি স্পষ্টতই তাদের ভবিষ্যত নির্ধারণ করে। ভালো শিক্ষার্থী কে? তাদের গুণাবলি কী? ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন গবেষণার আলোকে একজন আদর্শ শিক্ষার্থীর গুণাবলি তুলে ধরার চেষ্টা করবো এ প্রবন্ধে।
আদর্শ শিক্ষার্থীর গুণাবলি
ভালো শিক্ষার্থী শুধু পড়াশোনা করলেই হওয়া যায় না। এক্ষেত্রে আপনার থাকতে হবে বিশেষ কিছু গুণাবলি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
- শৃঙ্খলা
- সম্পর্ক তৈরি
- পরিশ্রমী
- টিম-প্লেয়ার
- জ্ঞানসাধনা
- সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ
- আত্মবিশ্বাস
- ভালো শ্রোতা
- চমৎকার সংগঠক ইত্যাদি
এখন আমরা একজন আদর্শ শিক্ষার্থীর গুণাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই।
১. শৃঙ্খলা
একজন ভালো শিক্ষার্থীর গুণাবলি -এর মধ্যে প্রধান গুণ শৃঙ্খলা। এর মানে হচ্ছে- একজন শিক্ষার্থীকে সেরা হতে হলে তাকে অবশ্যই পড়াশোনার সময়সূচিটি কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। প্রতিদিন তার শিক্ষক ও পিতামাতার নির্দেশাবলি যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। ক্লাসে দেয়া হোমওয়ার্কগুলো গুরুত্বসহকারে সম্পন্ন করতে হবে। সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হবে।
২. সম্পর্ক তৈরি
একজন ভালো শিক্ষার্থী তার সহপাঠী, শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করেন। এটি তাকে পাঠ্যবহির্ভুত কার্যক্রমে অংশ নেয়া এবং কার্যকরভাবে অধ্যয়নের উপর গভীরভাবে মনোনিবেশ করতে সক্ষম করে। এছাড়াও, মানসম্পন্ন সম্পর্ক একজন ছাত্রকে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে স্টাডিগ্রুপের মতো বিষয়গুলিতে অংশ নেয়া সহজ করে তোলে। ফলে শিক্ষার্থী কঠিন বিষয়গুলি সহজে বুঝতে সক্ষম হয়।
৩. পরিশ্রমী
একজন ভালো ছাত্র অবশ্যই পরিশ্রমী হবেন। তার পাঠ শেষ করার জন্য প্রয়োজনে রাতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করবেন। মূল কথা হচ্ছে- একজন ভালো শিক্ষার্থী আলস্য ও দীঘর্সূত্রিতা পরিহার করে লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট থাকেন।
৪. শ্রদ্ধাবোধ
ভালো ছাত্ররা সব সময় দেশ, জাতি, সমাজ ও নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সামাজিক রীতি-নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। জাতীয় প্রয়োজনে তারা অ্যাকাডেমিক স্বার্থ ত্যাগ করতেও কার্পণ্য করেন না। ঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে স্বেচ্ছাসেবায় তারা অগ্রণী। দেশীয় আইন মেনে চলার পাশাপাশি ভালো ছাত্ররা শিক্ষক, সহপাঠীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকেন।
শিক্ষক, স্কুল কর্মচারী এবং সহপাঠীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার মানে হলো- আপনি একজন ভালো ছাত্রের চেয়ে বেশি — আপনি একজন ভালো ব্যক্তি। অতএব, আপনি করিডোরে যাদের সাথে দেখা হয়, তাদেরকে অভিবাদন জানান। কমপক্ষে একটু মুচকি হাসির অভ্যাস করুন।
৫. সৎ
একজন ভালো শিক্ষার্থীর আরেকটি গুণ হচ্ছে সততা। তারা সৎ থাকে তাদের কর্মে, তাদের মননে। তারা ফলাফল অর্জনের জন্য জন্য কোনো ধরনের অসদুপায় অবলম্বন করে না। পরীক্ষায় ভালো করার জন্য প্রতারণার আশ্রয় নেন না। তারা মনে করেন, ভালো স্কোরের চেয়ে বেশি জানাটা জরুরি।
৬. ভালো টিম-প্লেয়ার
ভালো শিক্ষার্থীদের অন্যতম একটি গুণ হচ্ছে তারা ভালো টিম প্লেয়ার। অনেক সময় একজন শিক্ষার্থীকে গ্রুপ কার্যক্রমে অংশ নিতে হয়। সেসব ক্ষেত্রে ভালো ফল পেতে হলে পরস্পরকে সাহায্য করা খুবই জরুরি। গ্রুপমেটদের প্রতিযোগী ভাবলে ভালো ফলাফল করা যাবে না।
৭. সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ
শিক্ষার্থীদের সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণে আলসেমি করা উচিত নয়। সেটা হতে পারে ক্রীড়া, আর্টস বা অন্য কোনো কিছু। কেননা এটা নেতৃত্বের দক্ষতা সৃষ্টিতে অপরিহার্য। সেজন্য একজন ভালো শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। তারা শুধু পড়াশুনা নিয়ে পড়ে থাকেন না।
৮. অংশগ্রহণমূলক
ভালো শিক্ষার্থীরা ক্লাসে অংশগ্রহণমূলক। শিক্ষকদের প্রশ্নের উত্তর দেয়া, ক্লাস লেকচারে অংশগ্রহণ তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ফলে তারা সহজেই শিক্ষকদের নজর কাড়তে পারেন। ফলে তাদের শেখাটা সহজ হয়। সুতরাং ভালো শিক্ষার্থী হতে হলে আপনার সংকোচ ঝেড়ে ফেলুন। ক্লাস পারফমেন্স বাড়াতে মনোযোগী হোন।
৯. জ্ঞানসাধনা
জ্ঞানসাধনা একজন ভালো শিক্ষার্থীর অন্যতম গুণ। তারা সবসময় নিজ নিজ ক্ষেত্রের জ্ঞানার্জনে ব্রত থাকেন। ফলে তিনি যত জানেন, ততই তার জ্ঞানপিপাসা বৃদ্ধি পায়। এভাবে তিনি সব সময় জ্ঞানার্জনের পথে সক্রিয় থাকেন।
১০. পাঠের প্রতি মনোযোগী
একজন ভালো ছাত্র ক্লাস লেকচারে পুরোপুরি মনোযোগী। শ্রেণীকক্ষে যখন শিক্ষক কোনো বিষয় আলোচনা করেন, তখনই তা আত্মস্থ করার চেষ্টা করেন তারা। কারণ একই জিনিস বোঝার জন্য দুইবার সময় নেই তাদের। ক্লাসের বিষয়গুলো ক্লাসেই সম্পন্ন করতে চেষ্টা করেন তারা। প্রাইভেট বা বাসার সময়টা তারা অন্যকাজে ব্যয় করেন।
১১. আত্মবিশ্বাস
আত্মবিশ্বাস ভালো ছাত্রদের একটি বড় গুণ। আমরা জানি, আত্মবিশ্বাস না থাকলে কোনো কাজেই সফল হওয়া যায় না। একজন ভালো ছাত্রের ভেতরে এ গুণটি অবশ্যই বিদ্যমান। আর এই আত্মবিশ্বাসের দ্বারা তারা অনেক সমস্যা সমাধান করে ফেলেন তারা। ফলে পড়াশোনার প্রতি তাদের আগ্রহ আরো বৃদ্ধি পায়।
১২. মিতব্যয়ী
ভালো শিক্ষার্থীদের অন্যতম একটি গুণ হলো তারা মিতব্যয়ী। তারা হিসাব করে খরচ করেন। প্রয়োজনমাফিক খরচ করেন। এই মিতব্যয়িতা তাকে পড়াশোনার ট্র্যাকে রাখতে সাহায্য করে। কারণ, বেহিসাবি খরচে একজন শিক্ষার্থী অসৎ পথে ধাবিত হতে পারে। পড়াশোনা ছেড়ে আড্ডাবাজি বা ভিন্ন কোনো জগতে জড়িয়ে যেতে পারে।
১৩. ইতিবাচক মনোভাব
ভালো শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুধু সামাজিক কার্যকলাপের জন্য আসেন না। তারা কঠোর পরিশ্রম করতে ভালোবাসেন। সেজন্য তাদের পূর্ববর্তী ভুলত্রুটিগুলো সংশোধন করে পরবর্তী ধাপে ভালো করার মানসিকতা পোষণ করেন। এবং কঠোর পরিশ্রম করে পেছনের গ্যাপগুলো পূরণ করেন।
১৪. গোল নির্ধারণ
ভালো শিক্ষার্থীদের সুনির্দিষ্ট গোল বা লক্ষ্য থাকে। তারা মূলত সে লক্ষ্য পূরণেই কাজ করেন। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়া ভালো ফলাফলের প্রত্যাশা অবান্তর। তাই একজন ভালো ছাত্র প্রতিটি সেমিস্টার বা পর্বের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা করে, সে অনুযায়ী কাজ সম্পাদন করেন।
১৫. ভালো শ্রোতা
একজন ভালো ছাত্র সবসময় ভালো শ্রোতা। তিনি ক্লাসে শিক্ষকের লেকচার মনোযোগ দিয়ে শোনেন। তাছাড়া ক্লাসের বাইরে শিক্ষক ও অভিভাবকের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেন। এতে করে তার পড়াশোনা ও জীবনে ভারসাম্য আসে। একজন ভালো ছাত্র হতে গেলে আপনার লিসেনিং স্কিল বাড়ানো জরুরি।
১৬. ধৈর্যশীল
আপনি যত জিনিয়াসই হোন না কেন, জীবনে কঠিন সময় আসতেই পারে। অনেক বিষয়ও কঠিন হতে পারে। আপনার যদি ধৈর্য না থাকে, তাহলে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা সম্ভব হবে না। খারাপ সময়ে বা কঠিন বিষয়ে ধৈর্য না হারিয়ে কঠোর অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে হবে। কোনোভাবে শেখা বন্ধ করা যাবে না।
১৭. ভারসাম্যপূর্ণ
একজন ভালো শিক্ষার্থী ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপন করেন। তারা ভুলে যান না যে, তাদের পরিবার আছে, ভাইবোন আছে। এ ছাড়াও আছে বন্ধু-বান্ধব। তাই পড়াশোনার বাইরে পরিবার, ভাইবোন বা বন্ধুদের জন্য সময় বের করেন তারা। পারিবারিক বা সামাজিক বিভিন্ন কাজে তাদের অংশগ্রহণ ঈর্ষণীয়।
১৮. স্বনির্ভর
ভালো ছাত্রদের অন্যতম একটি গুণ হচ্ছে- তারা স্বনির্ভর। লেখাপড়াসহ সব ক্ষেত্রেই তারা নিজের ওপর নির্ভর করে। সব ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগের জন্য বসে থাকেন না। তাছাড়া নিজের কাজ নিজে করতেই বেশি পছন্দ করেন তারা।
১৯. ভালো আচরণ
শ্রেণীকক্ষে ভালো আচরণ খুব সহজেই শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিক্ষার্থীর আচরণ ভালো, তারা ক্লাসের অন্যদের তুলনায় ভালো শিখতে পারে।
ক্লাসে অনেক স্মার্ট শিক্ষার্থী আছে যাদের আচরণ খারাপ, তারা শিক্ষকদের জন্য হতাশার কারণ হয়। কারণ এ ধরনের শিক্ষার্থীদের পরিচালনা করা শিক্ষকদের জন্য কঠিন হয়। সেকারণে এক পর্যায়ে তাদেরকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন শিক্ষকেরা। ফলে অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে ওই শিক্ষার্থীরা। তাই ভালো শিক্ষার্থী হতে ভালো আচরণ খুবই জরুরি।
২০. সিরিয়াসনেস
ভালো শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি সাধারণ গুণ দেখা যায়। সেটি হচ্ছে- সিরিয়াসনেস। তারা পড়াশোনা, পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট সবক্ষেত্রেই সিরিয়াস থাকে। ফলে তাদের ফলাফল অন্যদের থেকে আলাদা হয়। কোনো কারণে তারা যেন ব্যর্থ না হয়, সেব্যাপারে সবসময় সচেষ্ট থাকে। শিক্ষকদের কাছেও তারা সিরিয়াননেসের কারণে আলাদা গুরুত্ব পায়।
২১. আশাবাদী
পুরো শিক্ষাকাল একজন শিক্ষার্থীর জন্য মসৃন হয় না। শিক্ষাজীবনে উত্থান-পতন থাকতেই পারে। ভালো শিক্ষার্থীরা এক্ষেত্রে আশাবাদী প্রকৃতির হয়। কোনো কারণে কখনো খারাপ করলে, পরক্ষণেই তা শুধরে ভালো কিছু করার চেষ্টা করে। সামান্য কারণে আশাহত হয় না তারা।
২২. চমৎকার সংগঠক
একজন ভালো শিক্ষার্থী একজন চমৎকার সংগঠক। এ গুণই একজন ভালো ও গড়পরতা শিক্ষার্থীর মধ্যে ব্যবধান তৈরি করে। যে শিক্ষার্থী প্রতিদিনের একটি সময়সূচি করে নেয়, সে অবশ্যই অন্যদের থেকে ভালো ফলাফল করে।
পড়ার সময়, মূল্যায়ন সময়, পাঠ্যবহির্ভূত বিভিন্ন সাংগঠনিক কার্যক্রমে অংশ নেয়া ইত্যাদি একজন ভালো শিক্ষার্থীর অগ্রযাত্রায় ব্যাপক সহায়তা করে। বিশেষ করে স্কুল পরবর্তী জীবনে ব্যাপক সুবিধা লাভ করে তারা।
২৩. সরল মন
ভালো শিক্ষার্থীরা সাধারণত সাদাসিধা মনের হয়ে থাকে। তারা তাদের মনকে সহজসরল রাখে। সমস্যাগুলো ভেঙেচুরে সমাধান করে ফেলে।
২৪. কমিটমেন্ট
কমিটমেন্ট এমন একটি গুণ যা মানুষকে সবসময় আত্মবিশ্বাসী রাখে। একজন ভালো ছাত্রের মধ্যে এই গুণটি বিদ্যমান। ফলে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে তিনি অ্যাকাডেমিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারেন। স্বাভাবিকভাবেই তার ফলাফল ভালো হয়।
২৫. উচ্চাকাঙ্ক্ষী
উচ্চাভিলাষী শিক্ষার্থীরা কখনই ব্যর্থ হয়না। তারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। উচ্চাকাঙ্ক্ষা একটি ছাত্রকে কঠোর পরিশ্রম করতে এবং অসাধারণ ফলাফল অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করে যেতে সহায়তা করে।
২৬. শিখতে ইচ্ছুক
একজন ভালো শিক্ষার্থী সবসময় শিক্ষাগ্রহণে তৎপর। তারা শেখার সুযোগ পেলে তা লুফে নেয়। কোনো বিষয় না জানলে প্রশ্ন করে জেনে নেয়। শেখার ক্ষেত্রে কোনো বিষয় না পারলে অন্য কারো থেকে জেনে নেয়।
পরিশেষে বলা যায়, একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে উপরোক্ত সবগুলো গুণের সমন্বয় না-ও থাকতে পারে। তবে ভালো ছাত্রদের মধ্যে এই গুণগুলো বেশিরভাগই বিদ্যমান। প্রিয় পাঠক, আপনার দৃষ্টিতে একজন ভালো শিক্ষার্থীর গুণাবলি আর কী থাকা দরকার বলে মনে করছেন। জানান মন্তব্যে। আপনার সার্বিক মঙ্গল কামনা করছি।
সূত্রসমূহ :