আনিসুর রহমান এরশাদ : বিদ্যমান সমাজকে জ্ঞানভিত্তিক সমাজে রূপান্তর করার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে- সমাজের মানুষের জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে হবে ও মানবসত্তাকে জাগ্রত করতে হবে। জ্ঞানভিত্তিক সিস্টেমে জ্ঞানই প্রকৃত শক্তি। যার জ্ঞান আছে, সে-ই ক্ষমতাবান। জ্ঞানভিত্তিক সমাজের জন্য জ্ঞানদক্ষতায় নজর দেয়ার কোনো বিকল্প নেই; ব্যক্তিগত পর্যায়েও জ্ঞান ও দক্ষতার মূল্য এত বেশি যে জ্ঞানই ভবিষ্যত।
জ্ঞানভিত্তিক সমাজে কার দক্ষতা কী সেটাই তার পরিচয়; আভিজাত্য ও বংশপরিচয় গৌণ। যে যা জানেন, সেটাই তার শক্তি। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে মনের খোরাক মেটাতে বই পড়ার চর্চা- অভ্যাস বাড়াতে হবে, সভ্যতার সেতুবন্ধন গ্রন্থাগারকে আধুনিক অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত সুবিধাসম্পন্ন করতে হবে, বই সংরক্ষণ করতে হবে, মানসম্মত বই লেখায় উৎসাহিত করতে হবে, বইয়ের ক্রেতা ও প্রকাশক বাড়াতে হবে।
জ্ঞানভিত্তিক সমাজের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে হলে- অভিজ্ঞতা বৃদ্ধিতে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে হবে, কর্মপোযোগী গবেষক ও প্রয়োগযোগ্য গবেষণা আরও বাড়াতে হবে, প্রতিটি সেক্টরে ডিজিটাল রূপান্তর যথাযথ হতে হবে, মানবসম্পদ বিশ্বমানের হতে হবে, প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, জীবনধারা উন্নত হতে হবে, অর্থনীতি সমৃদ্ধ হতে হবে, উন্নয়ন টেকসই হতে হবে, কল্যাণ রাষ্ট্র গড়তে হবে।
যে জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞা নেবে; তার ডিজিটাল সরকার মানে জবাবদিহিতায় বিশ্বাসী স্বচ্ছ-দুর্নীতিমুক্ত সরকার, ডিজিটাল শিক্ষা মানে সময়ের উপযোগী যথার্থ শিক্ষা, ডিজিটাল অর্থনীতি মানে শিল্প-কল-কারখানা-ব্যবসা-বাণিজ্যে পরনির্ভরশীলতা কমিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ-বৈষম্যমুক্ত-ভেজালমুক্ত-প্রতারণামুক্ত জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি, ডিজিটাল সমাজে ডিজিটাল জীবনধারা মানে সুস্থ-সুন্দর-নিরাপদ শান্তি-স্বস্তির আধুনিক জীবনধারা।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে যুগের চাহিদা পূরণের দক্ষতা অর্জনে উপযোগী করার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণকেও বৈশ্বিক চাহিদা পূরণে সক্ষম সৎ-যোগ্য-দক্ষ সুনাগরিক গড়ায় সক্ষম হতে হবে। যারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অব থিংস ও রোবোটিক্স এর পরিবর্তিত অবস্থায়ও সম্মানজনক কর্মসংস্থানের সুযোগ করে নিতে পারে। প্রয়োজনীয় খাতে যথাযথ উচ্চ দক্ষতাবিষয়ক প্রশিক্ষণের আয়োজন বাড়াতে হবে সম্ভাবনার যথাযথ বিকাশের স্বার্থেই।
ডিজিটাল যুগের শিক্ষা দিয়ে এমনভাবে দক্ষ করে গড়ে তোলতে হবে যাদের নৈতিকতা থাকবে, মানবপ্রেম থাকবে, দেশপ্রেম থাকবে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজে কর্মক্ষেত্রকে এত ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করতে হবে- যাতে কেউ বেকার-পশ্চাৎপদ না থাকে। মানবসম্পদ সৃষ্টির ধারাকে এমনভাবে নতুন রূপে গড়তে হবে- যাতে জনগোষ্ঠী প্রস্তুত হয় দক্ষ জ্ঞানকর্মী হিসেবে। জ্ঞান যেহেতু কেউ কেড়ে নিতে পারে না, তাই নিজের জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়াতে কিছু বিনিয়োগ করতেও জ্ঞানভিত্তিক সমাজের মানুষের আপত্তি থাকে না।
জ্ঞানকর্মীরা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম হবে এবং ডিজিটাল কাজে সুদক্ষ হবে। প্রচলিত কাজ করার দক্ষতা সম্পন্ন শ্রমশক্তি বানানোর চেয়ে নতুন প্রজন্মকে জ্ঞানকর্মী বানানোর কাজকে অগ্রাধিকার দেয়ার মাধ্যমেই বেকারত্বের যন্ত্রণায় ভোগা থেকে মুক্তি দেয়া সম্ভব। অবশ্য শিক্ষকের যোগ্যতা, শিক্ষাদান পদ্ধতি এবং শিক্ষার বিষয়বস্তুতে ইতিবাচক পরিবর্তন না আনলে বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা জ্ঞানকর্মী তৈরিতে যথার্থ ভূমিকা রাখতে পারবে না।
শুধু ডিজিটাল যন্ত্র সহজলভ্য হলেই হবে না, যথাযথ ব্যবহার করা শেখানোও নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি সেক্টরে ইন্টারনেট ব্যবহারকে সংশ্লিষ্টদের আয়ত্তের মাঝে আনলেই হবে না, ইন্টারনেটের অপব্যবহারও রোধ করতে হবে। স্কুলের অবকাঠামোকে ডিজিটাল ক্লাসরুমের উপযুক্ত করে তৈরি করার পাশাপাশি শিক্ষকদেরকেও নতুনত্বকে আয়ত্বে নিতে হবে। ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও দেশীয় বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখেই পাঠক্রম ও পাঠ্য বিষয়কে ডিজিটাল যুগের জ্ঞানকর্মী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য উপযোগী করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক