আনিসুর রহমান এরশাদ

আমার লেখালেখির গল্প : আনিসুর রহমান এরশাদ

ছোটবেলা থেকেই টুকটাক লেখালেখি শুরু করেছিলাম। ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখে টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত আজকের টেলিগ্রাম পত্রিকায় ‘নকল’ নামে একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল। ১৯৯৯ সালের ২২ এপ্রিল ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সোনালী বার্তা সোনালী সাহিত্য পাতায় হাসি মুখ গল্পটি ছাপা হয়েছিল। তখন নিজের নামটি পত্রিকায় ছাপানো হরফে দেখার চেয়ে সুখের কিংবা প্রাপ্তির আর কিছু ছিল না। লেখা ছাপা হলে টাকা পাব, সেটা মাথায় ছিল না। মোজাম্মেল হক কাকা আমার কাছ থেকে হাতের লেখা নেয়ার পর কোনো পত্রিকায় ছাপানো হরফে দেখেই কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না, আনন্দেরও শেষ ছিল না।

বি.এ.এফ শাহীন কলেজ ঢাকার কলেজ বার্ষিকীতে একটি লেখা ছাপা কিংবা নিবন্ধ প্রতিযোগিতায় পুরস্কারপ্রাপ্ত একটি লেখা আদিত্য শাহীন সম্পাদিত জনভাষ্য নামের সংকলন গ্রন্থে ছাপার কারণে যতটুকু খুশি হয়েছিলাম তা বর্ণনাতীত। নিজের লেখা ও ছাপা দেখার ঘটনা এমন যে, নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না! নিজের লেখা নিজেই বারবার পড়ার ঘটনা ঘটেছে। যেন প্রথম প্রেমে পড়ার চেয়েও বেশি উত্তেজনা! জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন রচনা প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পাওয়াটা লেখালেখিতে দারুণ উৎসাহ জুগিয়েছে।

ত্রৈমাসিক নতুন কণ্ঠ নামে একটি ম্যাগাজিন বের করতে গিয়ে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে বুঝতে পারি একটি প্রকাশনার সাথে কত মেহনত-পরিশ্রম জড়িত। সম্পাদনা পরিষদের অন্যদের মধ্যে এখন দুইজন স্বনামধন্য ব্যাংকার আর একজন বেসরকারি টিভি চ্যানেলে সাংবাদিকতা করছেন। প্রয়াস নামক একটি সাহিত্য ম্যাগাজিনও সম্পাদনা করেছি। সম্পাদক হিসেবে তখনকার আবেগ-অনুভূতি এখন সামনে রাখলে মনে হয় যেকোনো প্রকাশনার পেছনেই অনেক মানুষের উত্তেজনা কাজ করে।

অণ্বেষণ নামক নিবন্ধ সংকলন সম্পাদনা করেছি। সম্পাদক হিসেবে তখন বুঝতে পারি আমি লেখালেখি ও প্রকাশনার প্রেমে পড়ে গেছি। মাসিক এডুকেয়ার নামে শিক্ষা ও ক্যারিয়ার বিষয়ক ম্যাগাজিন বের করার সময় নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে উপলব্ধি করি, বিজ্ঞাপন দাতা ও বিক্রেতাদের কদর। খুব ভালো করেই বুঝতে পারি একটি ভালো টীমওয়ার্ক একটি ভালো প্রকাশনার জন্য অত্যন্ত জরুরি। আর অনলাইন পোর্টালে কাজের হাতেখড়ি হয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্য এডিটরে। মাহমুদুর রহমান মনা ভাইসহ যাদের সাথে কাজ করেছি অনেকেই লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় অনেকদূর এগিয়েছেন; অবশ্য কয়েকজন সাংবাদিকতা পেশা ছেড়ে অন্য পেশায়ও যোগ দিয়েছেন।

মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমানের কাছ থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন লেখক

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পার করার পরও লেখালেখি ও বইপড়ার প্রতি প্রেম কমেনি এতটুকু। এক ধরনের প্রেম এখনও রয়ে গেছে। হেলাল ভাইয়ের সাথে পাক্ষিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকায় কনটেন্ট এডিটর হিসেবে কাজ করেছি। সুন্দর ও নিঁখুতভাবে কাজের জন্য সবার স্বতস্ফূর্ততা ও আন্তরিকতা যে কতটা প্রয়োজন তা বুঝেছি। মেকাপে যাওয়ার আগে একাধিকজনের একাধিকবার কনটেন্ট এডিটিংয়ের মূল্যটা বুঝেছি।

আমি এখন স্পষ্ট বুঝতে পারি আমি অর্থের জন্য নয়, লিখি প্রচণ্ড ভালোবাসা থেকে। লেখার প্রতিটি বর্ণের সাথে এমন ভালোবাসা জড়িয়ে থাকে যে একটি লেখা শেষ হলেই আরেকটি লেখার ইচ্ছা হাজির হয়! আসলে লেখালেখির কাজটি আমি আনন্দ নিয়েই করি এবং করতে চাই। হোক পত্র-পত্রিকার জন্য লেখা, অনলাইন পোর্টালের জন্য লেখা কিংবা ম্যাগাজিন-সংকলন-বইয়ের জন্য লেখা। লেখা লেখাই; এখানে চেষ্টা-উদ্দেশ্য-লেগে থাকাই বড় কথা!

দৈনিক পত্রিকায় সাব-এডিটর হিসেবে কাজ করার সময় দেখেছি- সে এক বিশাল জগৎ। বিশাল কর্ম তৎপরতা। বিশাল একটি টিম কাজ করে এর পেছনে। রিপোর্টার রিপোর্ট লেখে, সাব-এডিটর সম্পাদনা করেন, তারপর প্রুফ সেকশনে সম্পাদনা সহকারীদের হয়ে মেকাপ রুমে যায়। পত্রিকার অঙ্গসজ্জার আগে আন্তর্জাতিক ডেস্কে আন্তর্জাতিক সংবাদ লেখা, সম্পাদনা, ছবি বাছাইয়ের কাজ থাকে। এখানে কোনো কাজকে বা টীমের কারো কাজকেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

পৃষ্ঠাসজ্জার কাজ শেষ হওয়ার পরে পাতাটি বার্তা সম্পাদক বা হেড অব নিউজের হয়ে ছাপার জন্য প্রেসে যায়। সেন্ট্রাল ডেস্ক, মফস্বল বিভাগ, স্পোর্টস বিভাগ, ফিচার বিভাগ- এসব বিভাগ ও পাতা ভেদে সাব এডিটরদের কাজের পার্থক্য রয়েছে। নির্ধারিত কাজের বাইরেও যারা কলাম-মতামত লিখেন তাদের বিভিন্ন ইস্যুতে জানার আগ্রহ বাড়ে এবং বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বিষয়কে বিশ্লেষণের ক্ষমতা তৈরি হয়।

একটি ব্যাপার আমার মনে হয়, সেই সামহোয়্যার ইন ব্লগ থেকে শুরু করে বাংলাদেশ২৪অনলাইন ডটনেট পর্যন্ত দেখতেছি- অনলাইনে কতজন লাইক দিলো, কতজন শেয়ার করলো, কতটি মন্তব্য আসলো তা লেখকরা যেভাবে মূখ্য বিষয় মনে করেন; পত্রিকার মেকআপে বা বই-ম্যাগাজিনে ছাপার অক্ষরের অনুভূতি তা থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। নিজের লেখা টেবিলে রেখে কফি খেতে ভালো লাগে, কাজের ফাইলের ভেতরে নিজের লেখা রেখে দিতে ভালো লাগে, ওই প্রকাশনার ঘ্রাণ নিতেও ভালো লাগে। যখন কেউ লেখা চান, লেখার জন্য তাগাদা দেন; তখন লেখক হিসেবে লেখা দেয়াতে ভালো বোধ হয়। যখন ছাপানো লেখা সম্বলিত কোনো সংকলন-ম্যাগাজিন-পত্রিকা নিয়ে হাসতে হাসতে হাজির হন তখন তার আনন্দ দেখতে ভালোলাগে।

পরিবার বিষয়ে প্রকাশিত লেখালেখির সমন্বয়ে পরিবার বই প্রকাশের সময় খুব ভালোভাবে বুঝলাম- লেখাই সবকিছু নয়, লেখকই সবকিছু নয়। বই সমন্বিত প্রয়াসের ফলাফল। অনেকের মেহনত পরিশ্রমের ফল একটি সুন্দর বই। আমি লিখেছি। কিন্তু কেউ প্রকাশিত নিবন্ধ-প্রবন্ধগুলো একসাথে করে একমলাটে বের করতে বারবার উৎসাহিত করেছে, কেউ কভার ডিজাইন করেছে, কেউ প্রুফ দেখেছে, কেউ ভেতরের ইলাস্ট্রেশন করেছে, কেউ মুদ্রণ ব্যবস্থাপনা করেছে, কেউ প্রকাশনার অর্থ দিয়েছে এবং কেউ পান্ডুলিপি প্রস্তুতকালে চা-কফির কাপ টেবিলে বারবার পৌঁছায়েছে।

এখনতো আসলে ভেতরের তাগিদ থেকেই লেখি, লেখালেখি ও পড়াশুনার জগতেই থাকি, লেখালেখি করতে ভালোলাগে বলেই লেখালেখি করি। ফলে লিখতে-পড়তে কখনো ক্লান্তিবোধ হয় না; কারো উৎসাহ বা প্রশংসারও দরকার হয় না। তবে পাঠক যখন ভালোলাগা জানায় তখন আরো বেশি দায়বদ্ধতা অনুভব করি, সামনে আরো এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা পাই।

আনিসুর রহমান এরশাদ | লেখক ও সাংবাদিক

ক্যারিয়ার, ট্রেনিং ও স্কলারশিপ সম্পর্কে
exclusive তথ্য পেতে ফেসবুক গ্রুপে
জয়েন করুন-

Career Intelligence | My Career Partner

Scroll to Top