পাওলো কোয়েলোর জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৪ আগস্ট, ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো শহরে৷ দ্য অ্যালকেমিস্ট তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস, যা পৃথিবীর ৬৭টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী দেড় কোটিরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে৷
কৈশোরেই আমি লেখালেখি শুরু করি৷ আমার মা আমাকে বলেছিলেন, ব্রাজিলের মতো দেশে লেখালেখি করে কেউ জীবিকা অর্জন করতে পারেন না৷ আমি তা বিশ্বাস করে অন্য কিছু করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু এমন কিছু খুঁজে পাইনি, যেটা আমাকে আনন্দ দিতে পারে৷ ফলে আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিলাম এবং হিপ্পি সেজে দেশ ভ্রমণ শুরু করলাম৷ কিছুদিন পর আবার ব্রাজিলে ফিরে এসে একটা ম্যাগাজিন চালু করি৷
এরপর একসময় গানের জন্য কথা লেখার আমন্ত্রণ পেলাম এবং শেষে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হই৷ লেখালেখি করে আমি জীবিকা অর্জন করতে পারলাম, কিন্তু তখনো কোনো বই লিখিনি৷ যখন প্রথম বইটা লিখি, তখন আমার বয়স ৩৮ বছর৷ এত দেরি হওয়ার কারণ, আমি বিশ্বাস করতাম, কারও স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার কারণ হতে পারে দুটি৷ প্রথমত, মনে করা যে স্বপ্ন পূরণ হওয়া সম্ভব নয়; দ্বিতীয়, বুঝতে পারা যে এটা হওয়া খুব সহজেই সম্ভব৷ দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মানুষ নিজের জীবনের অর্থ হারিয়ে ফেলে৷ আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় সান্তিয়াগো ডি কম্পোস্টেলায় তীর্থযাত্রা৷ সে সময় আমি ঠিক করি, আমার জীবনের লক্ষ্য হবে মহাবিশ্বের রহস্যগুলোর সন্ধান করা এবং বুঝতে পারি যে এখানে আসলে কোনো রহস্যই নেই-জীবন সব সময়ই একটা ধাঁধা হয়ে থাকবে৷ আমাদের উচিত, প্রকৃতির সংকেতগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা এবং অন্যদের কথা শোনা৷ প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকাটা একটা বিস্ময় এবং আমরা যখন অন্য মানুষের মুখোমুখি হই, সেটা বুঝতে পারি৷ এই তীর্থযাত্রার পর আমি আমার আধ্যাত্মিক পথযাত্রাকে সরল করে তুলি এবং জীবনের নানা জটিল প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বন্ধ করি৷ কারণ, তখন উপলব্ধি করতে শিখেছি যে জীবন নিজেই সব প্রশ্নের সবচেয়ে বড় উত্তর৷
লেখালেখি খুবই নিঃসঙ্গ একটা কাজ৷ যখন একটা বই লিখি, আমি আত্মার মুখোমুখি দাঁড়াই৷ এতে নিজের মধ্যে এমন সব রাস্তার খোঁজ পাই, যা কখনো ভাবিইনি যে এটা আমার মধ্যে আছে৷ একটা বই লিখে শেষ করার পর অনুভব করি, আমি নিজের আলাদা একটা সত্তার জন্ম দিয়েছি; এমন একটা জিনিস সৃষ্টি করেছি, যেটা আমার অনুভূতি ও কল্পনাকে পাঠকের চিন্তায় ও হৃদয়ে পৌঁছে দেবে৷ এটা সম্পূর্ণ একটি জাদুকরি অনুভূতি৷ আমি লেখার মাধ্যমে চেষ্টা করি মনের প্রশ্ন ও সন্দেহগুলোকে তুলে ধরতে৷ আমার কাছে দর্শন জীবন্ত কোনো বস্তুর মতো৷ এমন কোনো বস্তু, যেটা আমাদের মনের প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভোল পাল্টায়৷ আমার লেখনীতে সবাইকে জানাতে চাই, ‘নিজের স্বপ্নে বাঁচো, এর জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে তৈরি হও, প্রকৃতির সংকেত বুঝতে শেখো, নিজের মানবিক দিকটাকে শক্তিশালী করো আর সবার শেষে নিজের ভিন্নতাকে সাহসের সঙ্গে তুলে ধরো৷’ আমার দুটো বই দ্য পিলগ্রিমেজ ও দ্য ভালকাইরি হলো ননফিকশন; আর বাকি গল্পগুলো সংকেত ও রূপক ব্যবহার করে লেখা আমার জীবনের নানা ঘটনার উপজীব্য৷ আমি বিশ্বাস করি, একজন লেখক শুধু সেটাই লিখতে পারেন, যেটা তিনি নিজে উপলব্ধি করেছেন-হয় সেটা বাস্তবে কিংবা পরাবাস্তবে৷ জীবনে যাঁদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়, তাঁদের প্রত্যেকেরই আমাদের জীবনে কোনো না কোনো ভূমিকা আছে৷ আমাদের মনের টানেই আমরা জীবনের লক্ষ্যের দিকে নিরন্তর ছুটে যাই৷ তাই, আমার লেখালেখির মূল অনুপ্রেরণা হলো নিজের নিয়তিকে পূর্ণতা দেওয়া৷ আমার কাছে আমার সব বই-ই ‘এ প্লাস’৷ এর কারণ, আমি সবটুকু প্রেরণা দিয়ে প্রতিটা বই লিখি৷ আমার কাছে নিজের চেয়ে আমার বইগুলো ভালো৷
লেখক হতে চাইলে একজনের প্রয়োজন হবে শৃঙ্খলা ও অনুপ্রেরণা, শক্তি ও দৃঢ় মানসিকতা, নিজের চেষ্টা ও স্রষ্টার করুণা৷ একজন লেখকের নিশ্চয়ই একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকবে, কিন্তু একজন ভালো লেখক নিজেকে তাঁর লক্ষ্যের পথে পরিচালিত হতে ছেড়ে দেবেন৷ আসলে সমাজে একজন লেখকের কাজ একজন বাগান-মালি কিংবা একজন ট্যাক্সিচালকের মতোই৷ আমরা শুধু আমাদের কাজকে ভালোবাসতে পারি, তাতে সবটুকু শ্রম ঢেলে দিতে পারি-মানুষ ও সমাজ এ থেকে আপনাতেই উপকৃত হবে৷
নবীন, যারা লেখক হতে চায়, তাদের জন্য আমার উপদেশ থাকবে, যত রকমভাবে পারো, অভিজ্ঞতা অর্জন করো; আমি এভাবেই শুরু করেছিলাম৷ মানুষ জানে না, একজন বেস্ট সেলিং রাইটার হওয়ার জন্য আমাকে কত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে৷ কতবার বাধার সম্মুখীন হয়েছি৷ আমার দ্বিতীয় বই দ্য অ্যালকেমিস্ট যখন প্রকাশিত হয়, তখন আমি এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম৷ বইটা প্রথমে একটা স্বল্পপরিচিত প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়৷ যদিও এর বিক্রি ভালোই হচ্ছিল, কিন্তু এক বছর পরই প্রকাশক বইটার স্বত্ব আমাকে ফিরিয়ে দিলেন এবং জানালেন যে তিনি স্টক মার্কেট থেকে এর চেয়ে বেশি টাকা উপার্জন করতে পারেন৷ এতে আমি এতটাই হতাশ হয়ে পড়ি যে আমার স্ত্রীকে নিয়ে রিও ছেড়ে চলে যাই মজেভ মরুভূমিতে, ৪০ দিন নিঃসঙ্গবাস করি৷ আমি চেয়েছিলাম এই মনঃকষ্ট থেকে মুক্তি পেতে৷ যখন ফিরে এলাম, নিজের মধ্যে লড়াই করার প্রেরণা খুঁজে পেলাম৷ আমার জীবন থেকে বুঝতে শিখেছি, জীবনে ভয় ও ক্ষত থাকা সত্ত্বেও আমাদের করণীয় হচ্ছে, স্বপ্নপূরণের জন্য লড়াই করা৷ বোর্হেতাঁর লেখায় বলেছেন, ‘সাহসী হওয়ার চেয়ে বড় পুণ্য আর নেই৷’ সাহসী হওয়া মানে এই নয় যে আমি ভয় পাই না; সাহসী হওয়া মানে এই যে আমি ভয়কে উপেক্ষা করেও এগিয়ে যেতে পারি৷
সূত্র: ওয়েবসাইট, ইংরেজি থেকে
অনুবাদ: মনীষ দাশ
সৌজন্যে : প্রথম আলো