বার কাউন্সিলের লিখিত পরীক্ষা স্থগিত এবং আইন শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ

বার কাউন্সিলের লিখিত পরীক্ষা স্থগিত এবং আইন শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ

আব্দুল্লাহ আল মাহাদী : ২০১৭ ও ২০২০ ব্যাচের এমসিকিউ উত্তীর্ণ ১৩ হাজার শিক্ষানবিশ আইনজীবির ৩ ধাপের এনরোলমেন্ট পরীক্ষার ২য় ধাপ অর্থাৎ রিটেন পরীক্ষার তারিখ নির্ধারিত ছিল ২৬ সেপ্টেম্বর। কিন্তু গত ২০ সেপ্টেম্বর একটি নোটিশে নির্ধারিত তারিখে পরীক্ষা হচ্ছে না বলে জানানো হয়। এতে পরীক্ষার্থীদের অনেকে আনন্দ প্রকাশ করলেও বিষয়টি গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

২৬ সেপ্টেম্বরের পরীক্ষাটি স্থগিত হওয়ায় যারা আনন্দ প্রকাশ করছেন তাদের অধিকাংশই বৃহত্তর স্বার্থের কথা না ভেবে কেবল নিজের প্রস্তুতির কথা ভেবে আনন্দ প্রকাশ করছেন। তারা মনে-প্রাণে চাচ্ছিলেন যে, ২৬ তারিখের পরীক্ষাটি আরো কিছুদিন পেছানো হোক যাতে লেখাপড়া করে আরেকটু মজবুত প্রস্তুতি নেয়া যায়। কিন্তু এই ১৩ হাজার পরীক্ষার্থীর একটি বড় অংশ দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে যাতে এই করোনাকাল বিবেচনা করে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ৩ ধাপের পরীক্ষার শুধু লিখিত পরীক্ষার ধাপটি মওকুফ করে দ্রুত ভাইভা নেয়ার উদ্যোগ নেয়।

তাদের এই দাবির পিছনে অতীতের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে বেশ কিছু যৌক্তিক কারণও রয়েছে। যার অন্যতম কারণ হলো- বার কাউন্সিলের অতীতের রেকর্ড খুবই খারাপ। একজন আইনের ছাত্র আইন পাস করে অনির্দিষ্ট কাল অপেক্ষার পর যখন এমসিকিউ পরীক্ষা নামক পুলসিরাত পার হয়ে রিটেনের জন্য প্রস্তুতি শুরু করে তখন যেন শুরু হয় অপেক্ষার আরেকটি অধ্যায়। প্রায় বছর খানেক অপেক্ষার পর সুযোগ আসে রিটেন নামক সোনার হরিণ দেখার। কিন্তু খাতা দেখা শেষ হয় না আরো অর্ধ বছরেও। এরপর রিটেনের রেজাল্টের পর ভাইভা, তারপর চূড়ান্ত রেজাল্ট ঘোষণা। এরপরও বাকি থাকে আরো কিছু আনুষ্ঠানিকতা। এসব করতে করতে আইনের শিক্ষার্থীদের জীবন-যৌবন সব প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।

কেউ হয়তো ভাগ্যগুণে বা বাপের টাকার ওপর ভর করে ততোদিনে বিয়ে-শাদী করে ২-৩ সন্তানের জনক বা জননীও হন। অনেকে এ পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় নাম লেখান। অনেকে নাম লেখান টাউট বাটপারের খাতায়ও, জীবন-জীবিকা চালাতে অসৎ পথে হাটতে বাধ্য হন কেউ কেউ।

যাইহোক, তবে ২৬ তারিখের এই পরীক্ষা পিছানোর নোটিশকে আন্দোলনকারীদের অনেকেই জেনেবুঝে ইতিবাচক বলেও মন্তব্য করেছেন। তাদের প্রত্যাশা যে, আপাতত পরীক্ষা স্থগিতের নোটিশ এসেছে এবং অচিরেই তাদের দাবি অনুযায়ী এই রিটেন পরীক্ষা মওকুফ হওয়ারও নেটিশ আসবে। আন্দোলনের নেতারা এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের আশ্বাসের বরাত দিয়ে এমনটাই দাবি করছেন। সে হিসেবে প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা স্থগিতের এ নোটিশটি অবশ্যই আন্দোলনের সফলতার দ্বিতীয়াংশ বলা যেতে পারে।

বলাবাহুল্য, ২৬ তারিখে পরীক্ষার যে তারিখটি ঘোষণা করা হয়েছিল তা ছিল চলমান আন্দোলনেরই প্রথম ফসল বা সফলতার প্রথমাংশ। আন্দোলন থামাতে তড়িঘড়ি করে একটি তারিখ ঘোষণা করা হয়েছিল তখন। যাতে আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি হয় এবং তারা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে রাজপথ ছেড়ে ঘরে ফিরে যায়। কিন্তু কোনোভাবে আন্দোলন থামেনি, আন্দোলন এখনো অবিরত।

তাহলে প্রশ্ন হলো- শেষ পর্যন্ত যদি কোনো কারণে আন্দোলনকারীদের দাবি পূরণ না হয় অর্থাৎ দ্রুত সময়ের মধ্যে রিটেন পরীক্ষা মওকুফ এবং ভাইভার তারিখ ঘোষণা করা না হয় তাহলে কী হবে?

উত্তরে বলা যেতে পারে যে, অনির্দিষ্ট কালের পরীক্ষা স্থগিতের এই নোটিশের মাধ্যমে শুধু ১৩ হাজার নয় বরং ভবিষ্যতের সকল শিক্ষানবিশ তাদের জীবন হতে আরো কয়েকটি বছর হারিয়ে ফেলবে। পরবর্তী ব্যাচের এমসিকিউ পরীক্ষার্থীদের মধ্যেও ব্যাপক খারাপ প্রভাব পড়বে, তাদের এমসিকিউ পরীক্ষা কবে নাগাদ অনুষ্ঠিত হবে তা এখন প্রশ্ন করাও যেন হাস্যকর ব্যাপার। অনন্তকালের জন্য এ যাত্রা যেনো নিরুদ্দেশ পথে নিয়ে যাবে সবাইকে, আইন পড়তে এসেছে যারা তারা যেন সব মহাপাপ করেছে এ জনমে।

তবে যার যাই হোক না কেন লাভবান হবে সংশ্লিষ্ট কোচিং ব্যবসায়ীরা। তারা সবসময় পরীক্ষার্থীদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে চায়। তাদের অনেকে চায় যে, এসব শিক্ষার্থীরা অনন্তকাল তাদের কাছে কোচিং করে যাক এবং প্রয়োজনে এসব পরীক্ষা ৩ ধাপের পরিবর্তে ৬ বা ৯ ধাপে অনুষ্ঠিত হোক। একই রকম আশা-আকাঙ্খা বাজারের গাইড বইগুলোর প্রকাশকদেরও। এসব অসাধু সিন্ডিকেট অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ। চলমান আন্দোলন নষ্ট করতে এরা শুরু হতেই কল-কাঠি নাড়ছে, বিভক্তি ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে সবসময়।

সর্বপরি কথা হলো- বার কাউন্সিলের দীর্ঘদিনের অনিয়ম-দুর্নীতির ফাঁদ হতে দুর্ভাগা বর্তমান এবং ভবিষ্যত শিক্ষানিবশদের মুক্তির জন্য একটি পরিবর্তন খুবই জরুরি। শিক্ষানবিশরা আগেও অনেকবার নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নানা দাবি তুলেছে, কঠোর আন্দোলনও করেছে। তবে করোনাকালীন এ আন্দোলনে যদিও লোক সমাগম কিছুটা কম তথাপি এর ব্যাপকতা অনেক বেশি। ইতোমধ্যে বিষয়টি জাতীয় সংসদেও উত্থাপন হয়েছে। সরাসরি মাননীয় আইনমন্ত্রীও আন্দোলনকারীদের সাথে সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। এমনকি করোনাকালে যখন সারা বিশ্ব ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, তখন শিক্ষানবিশদের রিটেন পরীক্ষা মওকুফের যথেষ্ট যৌক্তিক কারণও বার কাউন্সিলের সামনে রয়েছে। দাবি মানতে কোনো বাধা-বিরোধিতা নাই। তারপরও যদি বার কাউন্সিল কোন কিছুতেই কর্ণপাত না করে, তাহলে এই প্রতিষ্ঠানের লাগামহীন স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির হাত থেকে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কোনো আইন শিক্ষার্থীই রক্ষা পাবেনা। শুধু আইন শিক্ষার্থীরাই নয়, বরং গোটা আইনজীবি পেশাটাই অসম্মানের ও অযোগ্যদের পেশায় পরিণত হবে। অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে দেশের আইনাঙ্গন।

লেখক : সাংবাদিক

(এ লেখায় প্রদত্ত তথ্য ও মতামতের দায় একান্তই লেখকের)

ক্যারিয়ার, ট্রেনিং ও স্কলারশিপ সম্পর্কে
exclusive তথ্য পেতে ফেসবুক গ্রুপে
জয়েন করুন-

Career Intelligence | My Career Partner

Scroll to Top