ক’দিনের জন্য কাজকে ছুটি দিন

প্রতিনিয়ত কাজের মধ্য দিয়ে আমাদের চলতে হয়। এতে শরীর ও মনে দীর্ঘ মেয়াদি চাপ পড়ে। চাইলেও চাপ থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ হয় না। কিন্তু বিষয়টি সত্যিকার অর্থে নির্ভর করে আপনার সদিচ্ছার ওপর। স্রেফ কাজকে ক’দিনের জন্য ছুটি দিন। বেড়িয়ে আসুন কোথাও থেকে। দেখবেন আপনার শরীর ও মন কেমন তরতাজা হয়ে ওঠে। এ নিয়ে লিখেছেন অধ্যাপক ডা: শুভাগত চৌধুরী

তখন আমি তরুণ ডাক্তার। চল্লিশ বছর আগের কথা। যে রোগীকে দেখছিলাম তিনিও বয়সে তরুণ। রোগী, পরীক্ষার উঁচু শয্যায় বসলেন। চোখে-মুখে দুঃখ, অসুখের চিত্র, অবিরাম কাশছেন, চোখ জবাফুলের মতো লাল, মাঝে মধ্যে কেঁপে কেঁপে উঠছিলেন, ভারী কম্বলে মোড়া শরীর শীত মানছিল না। জ্বর মেপে পাওয়া গেল ১০৩ ডিগ্রি। রোগীর সাথে কথা বলে, শরীর পরীক্ষা করে মনে হলো ইনফ্লুয়েঞ্জা। তখন টেস্ট করার বালাই ছিল না, টেস্ট এত আবিষ্কৃতও হয়নি। তখন ডাক্তাররা নাভি টিপে, রোগী পরীক্ষা করে কথা বলেই বেশির ভাগ রোগ নির্ণয় করতেন। জ্বর হলে একটি লাল বর্ণের মিক্সচার ছিল বোতলে ভরে, গায়ে দাগকাটা কাগজ সেঁটে দিতেন কম্পাউন্ডার। এক দাগ করে তিন বেলা সেবন। বড়ির মধ্যে এপিসি ট্যাবলেট। মাথা ধরলে স্যাবিড়ন। কফ কাশে তুলসী পাতার রস, নয়তো বাসক সিরাপ।

আমি দিলাম এপিসি বড়ি, গরমজল দিয়ে গড়গড়া করার পরামর্শ ও বাসক সিরাপ। ‘বাড়ি যান এবং বিশ্রাম করুন’ বললাম আমি।
চোখ তুলে তিনি তাকালেন আমার দিকে। ‘বাসায় গিয়ে বিছানায় শোবো? আমাকে এখন কাজে যেতে হবে।’ ভারী চাদর দিয়ে শরীর মুড়িয়ে হনহন করে ছুটলেন তিনি।
অবাক লাগল। এ অবস্থায় কাজ করা? এমন জ্বর নিয়ে কাজ করার কথা ভাবলেন তিনি কী করে? আর ফ্লু ভয়ানক ছোঁয়াচে, কর্মস্থলে কত লোকের হবে সংক্রমণ!

তবে তার প্রতি সামান্য ভালোবাসা মিশ্রিত শ্রদ্ধাও জানাতে ইচ্ছা হলো। বেশ শক্ত সামর্থ্য মানুষ তো। ধুমজ্বর, শরীর অসুস্থ কিছুই তাকে কাজ থেকে বিরত করতে পারল না।
আমার হাউজ জব মাত্র শেষ হয়েছে। হাউজ ফিজিওশিয়ান থাকার সময় সবচেয়ে বড় অপরাধ হলো অসুস্থ হওয়া। এর মানে হলো অন্য কেউ আপনার কাজটা কবে দেবে- রোগী ভর্তি করবে, ফোন কল করবে, আইডি দেবে শিরায়, জরুরি অবস্থা মোকাবেলা করবে। যখন হাউজ অফিসার ছিলাম তখন আমার মনে আছে, শরীর অসুস্থ হওয়ার কারণে একদিনও কাজে গরহাজির হইনি। সামান্য জ্বর সর্দি হলেও এড়িয়ে গেছি।

তবে এরপরে যে অসুখের জন্য অল্প ছুটিছাটা কর্মজীবনে নিয়েছি, এও ঠিক। তবে পরে কর্মজীবনে দেখেছি, পেশাগত জীবনে, সর্দি জ্বর ও ফ্লুর জন্য কাজে হাজির থাকবে না এমন লোক কমই। সরকারি কাজে যারা, এরা ছুটি নিলেও প্রাইভেট জব যাদের, এরা চাকরি হারানোর ভয়ে, আবার অনেকে কর্মদিবসে ছুটি নিলে ঘরে চাল জুটবে না, দিন আনে দিন খান এমন লোক কাজ থেকে ছুটি নিতে চাইতেন না। অসুখ হয়ে ঘরে শুয়ে থাকার দিন নয়। অনেক রোগী সহানুভূতি, সমবেদনা এবং বন্ধুসুলভ পরামর্শেও টলেন না। এরা ডাক্তারের চেম্বারে যেন আসেন এন্টিবায়োটিক ব্যবস্থাপত্রের জন্য।
ফ্লু ও সর্দি জ্বর চিকিৎসায় এন্টিবায়োটিক দিয়ে কাজ হয় না- এ কথা ডাক্তাররা জানেন, জানেন অনেক রোগীও। ভাইরাল জ্বরে এর প্রয়োগ মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। আর এসব ওষুধের বিপদ ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তো আছেই।

অনেক সময় চিকিৎসকেরা যে এর ব্যবস্থাপত্র দেন না, তা নয়, রোগীরাও নিজেরা অনেক সময় সেবন করে ফেলেন। ওষুধের এমন অপব্যবহারে ড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া বা ‘সুপার বাগ’ সমস্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এলার্জি ও ইনফেকশাস ডিজিজের ডিরেক্টর ডা: এন্থনি ফসি বলেন, ‘ডাক্তারের চেম্বারে, ক্লিনিকে এবং জনগোষ্ঠীতে এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহারে ড্রাগ রেজিস্ট্যান্সের সমস্যা বাড়ছে।’ বিশ্বজুড়ে সমস্যার চিত্র একইরকম। ‘যেহেতু বেশির ভাগ ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে দ্রুত, এরা খুবই দ্রুত এন্টি মাইক্রোবিয়াল ওষুধের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্স গড়ে তোলে।’

লেখক : অধ্যাপক ও ডিরেক্টর, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম, ঢাকা।

ক্যারিয়ার, ট্রেনিং ও স্কলারশিপ সম্পর্কে
exclusive তথ্য পেতে ফেসবুক গ্রুপে
জয়েন করুন-

Career Intelligence | My Career Partner

Scroll to Top