অনলাইন পত্রিকা সম্পাদনায় সতর্কতা ও বিবেচনা

আনিসুর রহমান এরশাদ::::::::

অনলাইন পত্রিকার সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল। দ্রুত আপডেটসম্পন্ন অনলাইন সংবাদমাধ্যম জনপ্রিতায় চলে আসছে শীর্ষে। একে সামাজিক পাঠক পরিবর্তনের ইঙ্গিত হিসেবেও দেখছেন গণমাধ্যম বিশ্লেষকেরা। যারা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে মানুষের সংবাদ জানার আগ্রহ মেটাতে পারছে, সময়ের দাবি পূরণে ব্যতিক্রমধর্মী ও মানসম্মত করতে পারছে তারা পাঠকপ্রিয় হচ্ছে। অনলাইন পত্রিকা সম্পাদনায় উপযুক্ত ব্যক্তি হচ্ছে তারাই- যাদের খবর সম্পর্কে বোধ ও গভীরতা বা নিউজ সেন্স আছে, ২৪ ঘণ্টা চোখ-কান খোলা রাখতে পারে, একটানা অনেকক্ষণ কাজ করার মতো শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা আছে, লেখার হাত আছে এবং শিল্পের প্রতি আগ্রহ আছে। সংবাদপত্রের নির্দিষ্ট পাঠক থাকলেও অনলাইন পোর্টালের পাঠক বিশ্বব্যাপী। তাই এ মাধ্যমকে যত্ন সহকারে দেখা দরকার।

পাঠকের পছন্দকে গুরুত্ব দিন

যুক্তরাজ্যের গবেষকেরা জানিয়েছেন, অনলাইন সংবাদপত্রগুলোতে বিনোদন আর আবহাওয়ার খবরের পাঠকই থাকেন সবচেয়ে বেশি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে কম পাঠক রাজনীতির খবরের।  অনলাইন খবরের ক্ষেত্রে আবেগ দিয়ে লেখা ভাষার খবর বেশি পড়েন পাঠক। যেসব খবরের সঙ্গে ‘নারী’, ‘মা’, ‘যৌনতা’র মতো শব্দগুলো বেশি থাকে; সে খবরের পাঠক বেশি। ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা জানিয়েছেন, অনলাইন সাইটগুলোর পাঠকের বিশেষ পছন্দের খবর হচ্ছে বিনোদন আর তাঁদের কাছে সবচেয়ে অজনপ্রিয় খবর হচ্ছে রাজনীতি ও অর্থনীতির খবর। অনলাইনের পাঠকেরা সব সময় তাঁদের প্রিয় তারকার সর্বশেষ খবরাখবর ও সর্বশেষ ফ্যাশন সম্পর্কে জানতে চান। তাঁরা বিনোদন ও আবহাওয়া সংক্রান্ত খবরে যতটা উত্সুক থাকেন রাজনীতি আর অর্থনীতির খবরের ক্ষেত্রে তা দেখা যায় না।

সংবাদ হবে পরিপাটি-পরিশুদ্ধ-যথার্থ-সুপাঠ্য

যে হাউজের সাব এডিটর যত দুর্বল, সে হাউজের এডিটিং তত দুর্বল এবং সে হাউজের মেরুদণ্ড তত দুর্বল।সাব-এডিটর হচ্ছেন সংবাদপত্রের নেপথ্য নায়ক। তিনি তার সম্পাদনার দক্ষতার বৈচিত্র্য দিয়ে সংবাদপত্রের ভাবমর্যাদা নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। সংবাদ কপির একটি অপরিচ্ছন্ন, দুর্বল ও দুর্বোধ্য লেখাও তার হাতের ছোঁয়ায় হয়ে ওঠে পরিপাটি, পরিশুদ্ধ, যথার্থ ও সুপাঠ্য। সাব এডিটরের থাকতে হয়- অত্যন্ত সময় সচেতনতা, ভাষা ও ব্যাকরণ জ্ঞান; হতে হয় বন্ধুভাবাপন্ন, উদ্যমী, সৃজনশীল,রুচিবোধসম্পন্ন, শারীরিকভাবে সুস্থ।

ভুল তথ্যমুক্ত কনটেন্ট তৈরি

গুরুত্বপূর্ণ ও মজাদার সংবাদ সংগ্রহ ও বাছাই করার পর সম্পাদনার কাজ করেন সাব এডিটর। বানানরীতি, বাক্য গঠনের নিয়ম, ভাষাজ্ঞান ও পাঠকের জন্য সহজ বোধগম্য করে উপস্থাপনের জ্ঞান ন্যূনতম হলেও থাকতে হয়। যিনি বানান ও বাক্যের সুষম ব্যবহার জানেন, অভিধান ব্যবহার করতে জানেন তিনি আকর্ষণীয় হেডলাইন ও চমৎকার ইনট্রো লিখতেও পারেন। সাধারণ জ্ঞান, তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের দক্ষতা থাকলেই ভুল তথ্যমুক্ত কনটেন্ট তৈরি সম্ভব। সাব এডিটরের অযোগ্যতার ফলে হাউজের সুনাম নষ্ট ও দুর্নাম হবার সম্ভাবনা বেশি বৃদ্ধি পায়।

খবরের ফাঁদে পা দেয়া যাবে না

একজন গুছিয়ে লিখতে পারেন না, নিউজের গতিপথ ঠিক রাখতে পারেন না, নিউজের লক্ষ্য পূরণ বা ভারসাম্য নীতি সম্পর্কে জ্ঞান নেই তিনি তথ্য নিশ্চিত করবেন কীভাবে। নিউজের গুরুত্ব না বুঝলে অগ্রাধিকার দিয়ে সঠিক নিউজ বাছাই করা সম্ভব নয়। বিচক্ষণতা না থাকলে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে, সাম্প্রদায়িক হানাহানি তৈরি করে কিংবা আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় এমন খবরের ফাঁদে পা দিতে পারে সহজেই। যিনি সকল ধরনের নিউজের প্রতি আগ্রহী নন তিনি ভালো সাব এডিটর হতে পারবেন না, সাব এডিটরকে অলরাউন্ডার হতে হবে এবং কল্পনা শক্তি বাড়াতে হবে। যিনি বিরাম চিহ্নের ব্যবহার জানেন না, নিউজ সেন্স নেই,  বানানে কাঁচা আর বাক্য গঠনে দুর্বল; তিনি কী এডিটিং করবেন!

দ্রুত কাজ করতে লাগবে সমৃদ্ধ জ্ঞানভাণ্ডার

অনলাইন পত্রিকার সাব এডিটরকে তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিতে হয়, দ্রুত কাজ করতে হয়; ফলে থাকতে হবে জ্ঞানভাণ্ডার। নিউজ সংগ্রহ-বাছাই, ফন্ট কনভার্ট, ছবি বাছাই, শিরোনাম ঠিক করা এবং তা প্রকাশের উপযোগী করতে এডিট করতে হয়। যার একটি নিউজ এডিট করতে ১ ঘণ্টা লাগে তিনি অনলাইনে এডিটিংয়ের জন্য যোগ্য নন। নিউজের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি গুণগত মান বজায় রাখা জরুরি। অনলাইন সাংবাদিকতায় টাইপিং স্পিড ভালো হওয়া দরকার।

ভুল ট্রিটমেন্ট যাতে না হয়

সাব এডিটরের চোখ এড়িয়ে ভুল হলে হতে পারে নিউজের বড় ক্ষতি, প্রতিষ্ঠানের বড় ক্ষতি। উপযুক্ত ইনন্ট্রো তৈরি করা, সংবাদ পুনর্লিখন, প্যারা বিভাজন, যথাযথ শিরোনাম দেয়া, নিউজ সংশোধন ও নিউজটির উন্নতি করা হচ্ছে সাব এডিটরের কাজ। অথচ এডিট করতে গিয়ে যদি নিউজের মান আরো খারাপ হয় তবে আপনার ভুল ট্রিটমেন্টের কারণে দুর্নাম হবে হাউজের-প্রতিষ্ঠানের। আমি বলছি না যে- সাব এডিটরকে সব সময় অলরাউন্ডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে; তবে কিছুটা কল্পনা শক্তিতো থাকতে হবে।

সংশ্লিষ্ট আইন সম্পর্কিত জ্ঞান

কুসুমাস্তীর্ণ পেশা নয় সাংবাদিকতা, বহুমুখী সঙ্কটাপূর্ণ। সময় পাল্টেছে, সঙ্কট পায়ে দলে ভিন্ন চেহারা ও উজ্জ্বলতা নিয়ে এগিয়েছে। সবচেয়ে জীবন্ত-আধুনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক এই পেশা স্থবির হয়ে যায় যদি সমাজে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত না থাকে, চিন্তা-বিবেকের খোলা প্রান্তর অবারিত না থাকে, সাহসী-দেশপ্রেমিক ও সৃজনশীল সাংবাদিক না থাকে।

হাউজের নিজস্ব নীতি-নিয়ম জানা

যিনি লিখছেন তার স্বাধীনতার সাথে যেমন দায়িত্বশীলতা ও নৈতিকতার প্রসঙ্গ জোরেশোরে উচ্চারিত হয়। তেমনি যিনি টাকা বিনিয়োগ করেছেন তাকেও অদায়িত্বশীল হলে চলে না, খেয়াল-খুশি মতো স্বেচ্ছাচারিতা চালালে হয় না। এটা সত্য সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব অগ্রসর চিন্তা না করলে কিংবা মালিক-ব্যবসায়িক নেতৃত্ব ভিন্নমত ধারণ করার মতো উদারতা না দেখালে বিঘ্নিত হয় গতিশীলতা।

পাঠককে ধরে রাখা

অনলাইন পত্রিকায় ভুলে ভরা কনটেন্ট বেশি দেয়ার চেয়ে সঠিক কনটেন্ট কম দেয়াও নিরাপদ। বড় টিম নিম্ন-মধ্যম-উন্নত মানের দক্ষতাসম্পন্ন মানুষের সমন্বয়ে হতে পারে; তবে টীম যত ছোট হবে গুণমান বজায় রাখতে হলে অভিজ্ঞতা-পারদর্শীতার প্রয়োজন তত বাড়বে। কোয়ান্টিটি গুরুত্বপূর্ণ, তবে কোয়ালিটির ক্ষেত্রে ন্যূনতম মান বজায় না রেখে কোয়ান্টিটি বাড়ানো দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হবে। কোনো পাঠকের একবার সাইটের ব্যাপারে খারাপ ধারণা তৈরি হলে তাকে ধরে রাখা কঠিন হবে। অথচ যেকোনো সংবাদপত্রের প্রাণশক্তি হচ্ছে পাঠক।

পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখা

সংবাদে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠতাকে সব সময় ঊর্ধ্বে রাখতে হয়। কখনোই অন্ধভাবে কোনো বিশেষ মত বা দলের পক্ষ নেয়া যাবে না। সব সময় পাঠককে সত্য ও সঠিক তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আর পাঠকদের চাওয়া-পাওয়াকে প্রাধান্য দিতে হবে। নিরপেক্ষতা বজায় থাকলে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনেও নেতিবাচক কোনো প্রভাব ফেলে না। পক্ষপাতদুষ্ট, মানহীন ও অপেশাদার অনলাইন পত্রিকা পাঠকের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে পারে না। অনেকে নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব করতে যেয়ে বিরোধীমনা রাজনৈতিক দলের নিউজ পরিবেশনে রুচিহীন ও আক্রমণাত্মক শব্দের ব্যবহার করে। ফলে সার্বজনীন হয় না, সব ভিজিটর পত্রিকাটি পড়ে মজা পান না। দলবাজ মিডিয়া মানুষ পছন্দ করে না। সেই হাউজেই কর্মবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত হয়, যেখানে প্রফেশোনালিজম থাকে, টিম স্পিরিট থাকে, বসিং সিস্টেম থাকে না।

ইউনিক এবং ইনফরমেটিভকনটেন্ট

 ‘Content Is King’ অর্থাৎ কনটেন্ট সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। কনটেন্ট লেখা এবং সাইটে পাবলিশ করার আগে খেয়াল রাখতে লেখাটি ইউনিক এবং ইনফরমেটিভ কিনা। কনটেন্ট ইউনিক এবং ইনফরমেটিভ হলে ভিজিটর সেই সাইটে বেশি এংগেজ থাকে।

তরুণ-যুবক শ্রেণির জন্য কনটেন্ট

পাঠকের চাহিদা বিবেচনায় রেখে কনটেন্ট সাজাতে হবে।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি জরিপে বলা হয়েছে, সারা পৃথিবীতে গাণিতিক হারে নয় জ্যামিতিক হারে ইন্টারনেট ইউজার বাড়ছে। তথ্যের জন্য তরুণরা পত্রিকাকে পছন্দ না করে ভার্চুয়াল জগতকে বেশি পছন্দ করছে। অনলাইনে ১৬ থেকে ৪০ বছর বয়সের মানুষ বেশি আসে। বিশেষত কিশোর বয়স থেকে শুরু করে তরুণ ও যুবক শ্রেণির মধ্যে অনলাইনের পাঠকপ্রিয়তা সবেচেয়ে বেশি। এর সাথে একেবারে কিশোর বা টিনএজের ছেলেমেয়েরা সবচেয়ে বেশি অনলাইন পত্রিকার দিকে ঝুঁকছে।

বিভিন্ন আইটেমকেই গুরুত্ব দেয়া

নিউজপেপার ন্যাশনাল নেটওয়ার্কের এক গবেষণায় দেখা যায়, অনলাইন সংবাদপত্রে মানুষ পড়ে- ১. ব্রেকিং নিউজ/ নিউজ আপডেট (৯০%) ২. স্থানীয় সংবাদ (৮৩%) ৩. আবহাওয়ার খবর (৭৭%) ৪. বিনোদন (৭৫%) ৫. খাবার, রান্না-বান্না, ঘর-সংসার (৬১%) ৬. বাণিজ্য/প্রযুক্তি (৬০%) ৭. খেলাধুলা (৫৫%) ৮. স্বাস্থ্য (৫৪%)। ফলে বিভিন্ন বিভাগে ভালো কনটেন্ট দেয়াকে গুরুত্ব দিতে হবে।

আকর্ষণীয় ছবি ব্যবহার করা

সংবাদে ফটো/ইমেজ ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে। ভিজিটর বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে ছবি।সোস্যাল মিডিয়া এবং অন্যান্য প্লাটফর্মে একটি সুন্দর আইক্যাচি ফটোর সাথে ওয়েবসাইটের লিংক দেয়া থাকলে নরমাল যেকেনো সময়ের থেকে ওয়েবসাইট বেশি ভিজিটর পেয়ে থাকে। একটি ভালো ছবি কনটেন্টের পাঠকপ্রিয়তা অনেক বেশি বাড়াতে পারে।

প্রুফ সেকশন না থাকায় এডিটিংয়ে পারদর্শিতা

শুধু চাকরির মানসিকতা থাকলে অনলাইন পত্রিকার কোয়ালিটি বাড়ানো সম্ভব নয়। কোয়ালিটি, ভালোবাসা এবং প্রফেশোনালিজম থাকলে অনলাইন পত্রিকার সম্ভাবনা নিশ্চিত করা যাবে। এখানে মেধা এবং পরিশ্রমই প্রধান যোগ্যতা হবে। অলস ব্যক্তির স্থান অনলাইনে নেই, তিনি যতই মেধাবী হোন না কেন। আর কম্পিউটার ভালো জানতেই হবে। কম্পোজের স্পিড ভালো না হলে চলবে না। ইংরেজি না জানলে অনলাইনে না আসাই ভালো। আর শুদ্ধ বাংলা লিখতে না জানলে অনলাইন থেকে দূরে থাকাই ভালো।

ছবি-অডিও-ভিডিও এডিটিংও জানা

অনলাইন সাইট টিভি, রেডিও ও সংবাদপত্রের সমন্বিত রুপ। ভুলে গেলে চলবে না অনলাইন মাধ্যম রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের পরিবেশিত সংবাদের চরিত্র একসাথেই প্রস্ফূটিত করতে পারে। এখানে শ্রবণ, দর্শন ও মুদ্রণ একসাথে বাঙময় হয়ে উঠতে পারে। রেডিও বা টেলিভিশনে একবার শোনার পর দ্বিতীয়বার শোনার সুযোগ নেই। কিন্তু এখানে বারবার শোনা যায়, দেখা যায়, পড়া যায়। ছোট লেখা বড় করা যায়, বড় লেখা ছোট করা যায়।ফলে সাব এডিটরকে ছবি এডিটিং, অডিও এডিটিং, ভিডিও এডিটিংয়ের কাজও জানতে হবে। যাতে অনলাইন ভার্সনটিতে সংবাদের সাথে সাথে প্রয়োজনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও আগ্রহোদ্দীপক ঘটনার অডিও-ভিডিও ক্লিপ দেয়ার কাজ চালিয়ে নিতে পারে।

ক্যারিয়ার, ট্রেনিং ও স্কলারশিপ সম্পর্কে
exclusive তথ্য পেতে ফেসবুক গ্রুপে
জয়েন করুন-

Career Intelligence | My Career Partner

Scroll to Top