হোমমেড ক্যাটারিং : অল্প পুঁজিতে অধিক লাভের ব্যবসা

আজকাল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন অফিসে লাঞ্চ টাইম এবং নাস্তার সময়ে সবাই বাড়িতে তৈরি ফ্রেশ খাবার খেতে চায়। অথচ বাড়ি থেকে টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার নিয়ে যাওয়া তারপর ঠিক সময়ে বের করে খাওয়ায় রয়েছে অনেক ঝামেলা। আবার গরমে খাবার নষ্ট হয়েও যেতে পারে। বাড়ির ফ্রেশ খাবার যারা অফিসে বসে খেতে চান কিন্তু টিফিন বক্স বয়ে বেড়াবার ঝামেলায় যেতে চান না, তাদের জন্য এখন চালু হয়েছে বেশ কিছু হোম মেইড ক্যাটারিং হাউজ। এসব হাউজ থেকে কম খরচে ফ্রেশ খাবার পাওয়া যায়। এখন দুপুরের লাঞ্চে বা বিকালের নাস্তায় অফিসে বসেই বাড়ির খাবারের স্বাদ উপভোগ করার ববস্থা যারা করছে, তাদের অধিকাংশই কিন্তু ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক উদ্যোগী মহিলা। অল্প পুঁজি নিয়ে যেকোনো গৃহিণী ভালো আয়ের একটি উত্স হিসেবে এ কাজে হাত লাগাতে পারেন।

এ ব্যবসায় খুব বেশি পুঁজির প্রয়োজন নেই। পাঁচ ছয় হাজার টাকা আর কিছু ভাল খাবার তৈরির হাত থাকলেই সফল হতে পারবেন। এই ব্যবসায় যেসব অফিস বা স্কুলে আপনি খাবার সরবরাহ করতে ইচ্ছুক, সেখানে যোগাযোগ করে জেনে নিন খাবার সরবরাহের সুযোগ আছে কিনা। সুযোগ থাকলে কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানুন, দুপুরের লাঞ্চে বা বিকালের নাস্তায় তারা কী খাবার খেতে পছন্দ করে। প্রথম পাঁচ-ছয়জন গ্রাহককে সন্তুষ্ট করে নিয়মিত খাবার সরবরাহ করার অর্ডারটা নিয়ে নিন। ভালো খাবার সরবরাহ করতে পারলে আপনাকে আর কষ্ট করে বিজ্ঞাপনের কাজটি ঘুরে ঘুরে করতে হবে না। ভালো খাবারের সুনাম সবাই করে, দেখবেন পাঁচ-ছয়জন গ্রাহক থেকে আপনার সুনাম আরো পাঁচ-ছয়জনের কাছে ছড়িয়ে পড়েছে। এভাবে মাস খানেকের মধ্যে ব্যবসাকে লাভজনক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার মত গ্রাহক পেয়ে যাবেন।

কীভাবে শুরু করবেন

এই ব্যবসা যদি আপনি শুরু করতে চান, তাহলে আপনার প্রয়োজন আগ্রহ, রান্নায় পারদর্শিতা আর গ্রাহকের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করার যোগ্যতা। রান্নার কৌশলকে আরেকটু উন্নত করতে কিংবা বিশেষ কিছু ফাস্টফুড বা বেকারির খাবার তৈরি শিখে নিতে চাইলে নতুন গড়ে ওঠা রান্নার স্কুলে ভর্তি হয়ে যেতে পারেন। ক্যাটারিং সংশ্লিষ্ট অনেকেই এখন এসব স্কুল থেকে বিশেষ বিশেষ খাবার তৈরির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন। প্রায়ই এই ধরনের স্কুলগুলো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে নতুন রাঁধুনি ভর্তি করে থাকে। আপনার বাসার আশেপাশে অবস্থিত এমন কোনো একটি স্কুলে ভর্তি হয়ে যান।

টাকা-পয়সার হিসেবে আসলে এরকম একটি হোম মেইড খাবারের ক্যাটারিং ব্যবসায় হাত দিতে প্রাথমিকভাবে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা লাগবে শুধু খাবার তৈরির উপকরণ কিনতেই। আর যেকোনো ক্যাটারিং হাউজে রান্না শিখতে আপনার লাগবে কোর্সভেদে দুই থেকে দশ হাজার টাকা। ক্যাটারিং হাউজগুলোতে বেকারি, চাইনিজ, মোগলাই, ইউরোপিয়ান, ইতালিয়ান, দেশি—অনেক ধরনের খাবার তৈরিই শেখানো হয়। তবে যে খাবারটি কাস্টমাররা পছন্দ করবে, সেই খাবারটি রান্নাই বেশি ভাল করে শিখে নিন। এজন্য আগে থেকে কাস্টমারদের পছন্দটা জেনে নিন। আর বিকেলের নাস্তায় বা সকাল দশটা-এগারটার দিকে সবাই সাধারণত হালকা খাবার খেতে পছন্দ করে। এজন্য কেক, স্যান্ডউইচ, সমুচা, সিঙ্গাড়া, কুকিজের মতো হালকা খাবারগুলো তৈরি করতে শিখে নিন। এগুলো তৈরি করতে আপনার ওভেন দরকার হতে পারে। সেক্ষেত্রে আবার ওভেনের দাম পড়বে সাত থেকে দশ হাজার টাকার মতো।

ব্যবসার পরিধি

এ ব্যবসার পরিধি বর্তমানে বেশ বিস্তৃত। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিসপাড়া থেকে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতেও পৌঁছে গেছে হোম মেড ক্যাটারিং সার্ভিস। অনেক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরেই আজকাল হোম মেইড ফুড প্যাকেটে করে বিক্রি করা হচ্ছে। এসব খাবার পণ্যের মধ্যে রয়েছে- কেক, কুকিজ, বিস্কুট, দেশজ পিঠা, পনির, লাড্ডু, মোয়া, মুড়ালি, সিঙ্গাড়া, সমুচা, স্যান্ডউইচ ইত্যাদি। এসব খাবার প্লাস্টিকের স্বচ্ছ প্যাকেটে করে বাজারজাত করা সহজ ও অনেকদিন টাটকা থাকে। সিঙ্গাড়া, সমুচা আর স্যান্ডউইচ ভাল প্যাকেটে মুড়িয়ে দিলে দুই থেকে তিনদিন টাটকা থাকে। আর কেক, বিস্কুট, কুকিজ, পিঠা ইত্যাদি খাবার এক মাস থেকে দু’মাসও টাটকা থাকে। ভাল খাবার তৈরি করতে পারলে একটি ডিপার্টমেন্টাল দোকানে খাবার সরবরাহ করেই আপনি ভালো আয় করতে পারবেন। কিন্ডারগার্টেন স্কুলের বাচ্চারা কেক, সমুচা, সিঙ্গাড়া, স্যান্ডউইচ বেশি পছন্দ করে। একই কথা হাইস্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্যও প্রযোজ্য। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে খাবার জনপ্রিয় করতে পারলে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না।

আবার অফিসপাড়ায় খোঁজ নিয়ে দেখুন তারা কী খাবার চাচ্ছে। অনেক সময় অফিসে দুপুরের খাবার প্রয়োজন হতে পারে। দুপুরের খাবারে ভাত, সবজি, মাছ, ডিম, মাংস ইত্যাদি মেন্যু হিসেবে সরবরাহ করতে পারেন। এজন্য আপনাকে সুদৃশ্য টিফিন বক্সের ব্যবস্থা করতে হবে এবং খাবার পৌঁছে দিয়ে আসার জন্য একজন লোকও ঠিক করতে হবে। আরও একটি বিষয় খেয়াল রাখবেন, সবার তরকারির ঝাল নুনের স্বাদ সমান নয়। সেদিকে খেয়াল রেখে সবার জন্য সহনীয় রান্না করতে হবে। বিকেলের নাস্তায় অফিসে কেক, পিঠা, লুডলস সরবরাহ করতে পারেন। এছাড়া সমুচা, পুড়ি, পেঁয়াজু, সিঙ্গাড়া, মোগলাই পরোটা বা আপনার নিজের উদ্ভাবিত কোন হালকা খাবারের মেন্যুও পরিবেশন করতে পারেন।

দেশীয় খাবারের চাহিদা বাড়ছে

একটা সময় আমাদের বাঙালি মুখরোচক পিঠা, হালুয়া, লাড্ডু, সন্দেশ, বিদেশি ফাস্টফুড খাবারের জোয়ারে হারিয়ে যেতে বসেছিল। এখন অবশ্য অবস্থা পরিবর্তন হয়েছে। এজন্য ক্যাটারিং ফুডের সাথে যারা জড়িত আছেন, তাদের অবদান অস্বীকার করার মতো নয়। কর্মব্যস্ত এই শহরে ঘরে বসে সময় ব্যয় করে বিভিন্ন উপকরণ জোগাড় করে ব্যয়বহুল পিঠা, হালুয়া, লাড্ডু বানানো অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। অন্যদিকে ফাস্টফুড আইটেম সহজেই হাতের পাশের দোকানে পাওয়া যেত। এই বৈপরীত্যের কারণেই একসময় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ফাস্টফুড। তবে ক্যাটারিং হাউজগুলো ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে পুলি পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, নকশা পিঠা, তেলের পিঠা, নারু, হালুয়া, মোয়া ইত্যাদি সরবরাহ শুরু করলে এসব খাবারের জনপ্রিয়তা ফিরে আসতে শুরু করে।

বাঙালির এসব ঐতিহ্য ফিরিয়ে দিতে ও নতুন প্রজন্মকে নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে আজকাল আগোরা, পিকিউএস, নন্দন, মীনা বাজারের মতো বড় বড় সুপারস্টোরগুলোতেও সম্পূর্ণ হাতে বানানোন বিভিন্ন হোম মেইড খাবার পাওয়া যাচ্ছে। এ তালিকায় আছে বিভিন্নরকম ঐতিহ্যবাহী বাঙালী পিঠা-মালপোয়া, পাটিসাপটা, ফুল পিঠা, পাকান, পুলি, লবঙ্গ লতিকা, ক্ষীরপুলি ও দুধপুলিসহ নানা রকমের পিঠা। সাথে পাবেন নানা ধরনের হালুয়া। যেমন, গাজর, পেঁপে, বুট ও সবজির হালুয়া। এছাড়া নানা রকম সন্দেশ, নারকেলের নাড়ু, চিড়ার নাড়ু, তিলের নাড়ুসহ নানা রকম লাড্ডু ও মিষ্টি। এগুলোর দামও ক্রেতার নাগালের মধ্যেই। যেমন প্যাকেট প্রতি লাড্ডু ৭৫ টাকা থেকে ১৩০ টাকা, হালুয়া ৬৫ টাকা থেকে ১৪০ টাকা ও পিঠা প্রকারভেদে ৫৫ টাকা থেকে ১৮০ টাকা। আজকাল তরুণ-তরুণীদের কাছেও এসব খাবার বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।বেশ কিছু ক্যাটারিং খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এসব মুখরোচক বাঙালি খাবার সরবরাহ করছে। এর মধ্যে রয়েছে সুরকন্যা, বিক্রমপুর, পিঠাসর, প্রোটিনা, ফ্রেশ, হোমমেড, কেএনটি গার্ডেন ইত্যাদি। সারা বছরই এসব খাবারের চাহিদা থাকে। তবে বিশেষ বিশেষ উত্সবের দিন যেমন, শব-ই-বরাত আসলেই হালুয়ার চাহিদা বেড়ে যায়। আবার শীতকালে পিঠার চাহিদা বেশি থাকে। পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষে আবার লাড্ডু ও নারুর বিক্রি তুলনামূলকভাবে বেশি। এই দিকগুলোতে নজর রাখলে সাফল্য ধরা দেবেই।

সূত্র : ইত্তেফাক (ক্যারিয়ার ডেস্ক)  |  বুধবার, ১৩ জুন ২০১২, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯

ক্যারিয়ার, ট্রেনিং ও স্কলারশিপ সম্পর্কে
exclusive তথ্য পেতে ফেসবুক গ্রুপে
জয়েন করুন-

Career Intelligence | My Career Partner

Scroll to Top